ইনসাফ কমিটির জাতীয় সরকারের দাবি কী বার্তা দেয়

জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির প্রস্তাব অনুসারে একটি জাতীয় সরকার গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংস্কার করা হবে।
ছবি : সংগৃহীত

কিছুদিন পরপরই জাতীয় সরকার নিয়ে আলাপ তোলা হয়। সম্প্রতি ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’ নামের একটি সংগঠনের সভায় নির্বাচনের পূর্বেই একটি জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। সংগঠনটি ২০১৩ সালে গঠিত হলেও তেমন সক্রিয় ছিল না। রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে নৈশভোজের অনুষ্ঠানে জাতীয় সরকারের দাবি তুলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে সংগঠনটি। স্বভাবতই সংগঠনটি নিয়ে নানা ধরনের মতামত লক্ষ করা যাচ্ছে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, দেশে এখন জাতীয় সরকার কেন গঠন করতে হবে? বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ভোটের জন্য আন্দোলন করছে। দলগুলো বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি করছে। তাই জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই কমিটির প্রস্তাব অনুসারে একটি জাতীয় সরকার গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংস্কার করা হবে।

রাষ্ট্র সংস্কারের কথা অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষও চায়, রাষ্ট্রের সংস্কার করা হোক। কিন্তু জাতীয় সরকার গঠন করে রাষ্ট্রের সংস্কার কতটুকু বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক, তা আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ জাতীয় সরকার গঠনের মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছে কি না। রাজনৈতিক বিভাজন ও সংকট মোকাবিলায় বিবদমান দলগুলো নিয়ে জাতীয় সরকারের গঠনের উদাহরণ নিকট অতীতে খুব বেশি নেই। সাধারণত রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে সব দল দিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হয়। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৩১-৩৫ সালে ব্রিটেনে র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠন করা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসানের পর নেলসন ম্যান্ডেলা সরকারকেও অনেকে জাতীয় সরকার বলে থাকেন। কিন্তু তাদের প্রেক্ষাপট ও আমাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

জাতীয় সরকার নিয়ে আবারও আলাপ-আলোচনা শুরু করানো হচ্ছে বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশলের অংশ হিসেবেই। চাপ মোকাবিলার জন্য বিএনপি শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু আরও কিছু নেতা যদি জাতীয় সরকারের টোপ গিলে ফেলেন বা দল ত্যাগ করে নির্বাচনমুখী হন, তাহলে বিএনপি বেকায়দায় পড়ে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপি নিষ্ক্রিয় করে রাখা বা সাইডলাইনে ঠেলে দেওয়া নেতাদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আমাদের দেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের একটি সুযোগ ছিল। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথ ধরেনি। পরে অবশ্য ১৯৭৫ সালে দলটি নিজেদের বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন করেছিল।... কিন্তু এখন আমাদের দেশে জাতীয় সরকার গঠনের কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। এমনকি বিএনপির প্রস্তাব অনুসারে নির্বাচনের পর যে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে তারও কোনো  প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

বিএনপি কী বুঝে নির্বাচনের পর সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করছে, তা বোধগম্য না। বিএনপি যে প্রতিশ্রুতি দিতে পারে তা হচ্ছে, সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্রের সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া। রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। বিএনপি এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত রূপকল্প তুলে ধরতে পারে। বিএনপি অবশ্য এরই মধ্যে ২৭ দফা ঘোষণা করেছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য, কিন্তু নানা অসংগতি ও ত্রুটি থাকার কারণে এই ২৭ দফা তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি জনমনে। এই ২৭ দফা শুধু বিএনপির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। আর এটা করতে হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে প্রথমেই। এর কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদ প্রথমেই যে কাজটি করতে পারে তা হচ্ছে, সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা। গণভোটের আয়োজন করে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ একটি রাষ্ট্র সংস্কার কমিশন বা গণপরিষদ গঠন করতে পারে।

এই কমিশন বা গণপরিষদে সংসদ সদস্য ছাড়া সমাজের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও থাকতে পারেন। তারা রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্য একটি জনমুখী ও বাস্তবসম্মত সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেবে। কমিশন বা গণপরিষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে উদার ও প্রাণবন্ত আলোচনা করবে। একই সঙ্গে জেলায় জেলায় বা বিভাগীয় পর্যায়ে গণশুনানির আয়োজন করে সাধারণ মানুষের মতামত নেবে। দেশের মানুষ রাষ্ট্রকে কীভাবে দেখতে চায়, তা জানতে হবে ও তা সংবিধানে যোগ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার পর সংবিধানের খসড়া সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সংসদে অনুমোদিত হলে আবার তা গণভোটে দেওয়া হবে। গণভোটে দেশের মানুষ অনুমতি দিলে সংবিধানটি রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণ করা হবে। আর পুরো প্রক্রিয়াটিই জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে করা হবে। আসল কথা হচ্ছে, জনগণই রাষ্ট্রের সংস্কার করবে। কোনো অনির্বাচিত জাতীয় সরকার নয়।

দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের যা করা উচিত তা হচ্ছে, বিভেদ, সংঘাত ও দুর্নীতিকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানো। এটা করতে হলে প্রথমেই জনগণের সম্মতি অর্জন করতে হবে। আর তা করবেন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত নেতারা। অনির্বাচিত জাতীয় সরকারের কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে তা বদলে দিতে পারে। ফলে রাষ্ট্র আবার পেছনের দিকেই হাঁটতে শুরু করবে।

তাই আমাদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোরও চাপ আছে। চাইলেই ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই ঘুরেফিরে বারবারই জাতীয় সরকারের মতো একটি অনির্বাচিত ধারণা একধরনের দুরভিসন্ধি থেকে সামনে নিয়ে আসা হতে পারে। এর মূল উদ্দেশ্য হতে পারে নির্বাচন থেকে সবার মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া। জাতীয় সরকারের কথা বলে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি টোপ ফেলা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

শুধু তাদেরই নয়, নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকারবিষয়ক আলোচনায় যুক্ত হতে বিভিন্ন জোট এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে অনেকেই দাবি করছেন। বিএনপির সঙ্গে থাকা এবং সমান্তরালে আন্দোলন করা বিভিন্ন দলকে জাতীয় সরকারের কথা বলে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসার গোপন উদ্যোগও চলমান রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন নেতাকে এই উদ্যোগে শরিক করার চেষ্টা চলছে।

এসব রাজনৈতিক নেতাকে বোঝানো হচ্ছে, বিএনপি আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে আর কাবু করতে পারবে না। বিএনপিকে দিয়ে কিছু হবে না। বিকল্প বিরোধী নেতৃত্ব আপনাদের হাত ধরেই গড়ে উঠবে। ধারণা করা হয়, জাতীয় সরকারের প্রচারণা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনার অংশ। সম্ভবত এবার ক্ষমতার বৃত্তে থাকা ১৪ দলের অনেকেই বাদ যেতে পারেন। তাঁদের পরিবর্তে ১২ দলের অনেককেই সংসদে আনার টোপ দিতে পারে আওয়ামী লীগ।

বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকারের কথা বলে বিএনপির জোট ও জোটের বাইরে থাকা ১২ দলসহ সমমনা দলগুলোকে প্রথমে বের করে আনা ও এরপর নির্বাচনমুখী করার কৌশল নেওয়া হতে পারে। এর সঙ্গে উকিল আবদুস সাত্তারের মতো বিএনপির ভেতরে থাকা ক্ষুব্ধ নেতাদের নির্বাচনে টানা হতে পারে। ক্ষুব্ধ নেতাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চয়ই এসব বিষয়ে সক্রিয় হয়েছে। ফলে একটি বড় অংশই বিএনপি বাদ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে উকিল আবদুস সাত্তার হতে চাইবেন। এই পরিস্থিতি বিএনপি কীভাবে সামাল দেবে তা  তাদের ভাবতে হবে।

মূলত, জাতীয় সরকার নিয়ে আবারও আলাপ-আলোচনা শুরু করানো হচ্ছে বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশলের অংশ হিসেবেই। চাপ মোকাবিলার জন্য বিএনপি শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু আরও কিছু নেতা যদি জাতীয় সরকারের টোপ গিলে ফেলেন বা দল ত্যাগ করে নির্বাচনমুখী হন, তাহলে বিএনপি বেকায়দায় পড়ে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপি নিষ্ক্রিয় করে রাখা বা সাইডলাইনে ঠেলে দেওয়া নেতাদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে ও জেলায় জেলায় এসব নেতাকে বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সভা, সমাবেশে সভাপতির আসনে বসানো হচ্ছে। কিন্তু এতে দেরি হয়ে গেল কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক