বাংলাদেশের নবীন প্রজন্ম বাংলাদেশকে উদ্ধার করার মহৎ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজপথে নেমে কাজ শুরু করেছে। তারা অসম সাহসী ও বীর এক প্রজন্ম। এ বয়সে তা–ই হওয়ার কথা। এই প্রজন্মকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু পাশাপাশি তাদের সজাগ থাকতে অনুরোধ করি যেন তাদের উদ্যোগ দিশা না হারায়। যেন তাদের মধ্যে কেউ বাগড়া দিতে না পারে, আবার তাদের মধ্যেও কেউ লোভ ও পদের মোহে প্রতারণা বা অতি অহংকারী হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে ভুল করে পথভ্রষ্ট না হয়। যেহেতু তাদের আকাঙ্ক্ষা বড়, সেহেতু তাদের দায়িত্বও বড়।
এবারের আন্দোলনে যে চমৎকার স্লোগানের উদ্ভব হয়েছিল তা হচ্ছে, ‘বৈষম্য মানি না’। কিসের বৈষম্য এটি না বলতে পারলে কিন্তু ‘বৈষম্য’ ধারণাটি মূর্ত হয় না। আমরা জানি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্য হচ্ছে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য। সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নানা রকম মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের বৈষম্য। এ ছাড়া জেন্ডার বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, শ্রেণিগত বৈষম্য ইত্যাদি হাজার হাজার বছর ধরে সমাজে বিদ্যমান এবং মানবজাতির সর্বজনীন লক্ষ্যই হচ্ছে সভ্যতার অগ্রযাত্রার মাধ্যমে তা ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা।
বাংলাদেশে তরুণদের এই বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন কয়েকটি ঐতিহাসিক শান্তিপূর্ণ ধাপের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়েছিল। আমাদের দেশে শুরুতে তরুণদের এই আন্দোলন ছিল খুবই নিরীহ একটি ‘কোটা বণ্টনে’ বৈষম্য কমানোর আন্দোলন। দেখা যাচ্ছিল, প্রথমত সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা’কে মাত্র ৪৪ শতাংশ গুরুত্ব দিয়ে অন্যান্য বিষয়কে ৫৬ শতাংশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তরুণেরা ভেবেছেন, এতে অন্যান্য দিকের বিচারে মেধাকে বৈষম্যের শিকারে পরিণত করা হয়েছে। কাজেই সরকারি কর্মচারী হওয়ার সুবিধাটি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এমন সব বৈশিষ্ট্যের ওপর, যার সঙ্গে পেশাগত দক্ষতার কোনো যোগাযোগ নেই। উপরন্তু প্রচণ্ড স্বজনপ্রীতি, দলীয় প্রীতি এবং ঘুষ, ভুয়া সার্টিফিকেট ইত্যাদি নানা রকম দুর্নীতির মাধ্যমে এই বৈষম্যকে প্রতিনিয়ত তীব্রতর করা হচ্ছিল।
যোগ্য-মেধাবী-পরিশ্রমী–দরিদ্র পিতার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা বঞ্চিত ও অসম আচরণের শিকার হতে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে থাকে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ। তবে কেউ কেউ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই না করে কীভাবে ওপরে ওঠা যায়, তার চেষ্টাও করেছেন। কষ্ট করে ঘুষের টাকা বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য পারিবারিক জমি বেচে বা বাপের সর্বস্ব পুঁজি করে অথবা তথাকথিত ‘বড় ভাই’কে ধরে বা বাধ্য হয়ে তাঁরা ক্ষমতাসীন রাজনীতির টুপি মাথায় দিয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ওপরে ওপরে আনুগত্য দেখালেও মন থেকে তাঁরা মেনে নেননি। যদিও হলে হলে ছাত্রলীগ নেতারা তা বুঝতে পারেননি। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, হলগুলোয় ছাত্রলীগের বিকল্প কোনো রাজনৈতিক আদর্শবাদী শক্তিও তাদের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি।
ব্যাপক নির্যাতিত ছাত্রদের মধ্যে এতে রাজনীতির প্রতি তীব্র অশ্রদ্ধা জমতে থাকে। এই নতুন প্রজন্ম নিজের নিকট অভিজ্ঞতায় জেনেছে যে রাজনীতির অপব্যবহার রাজনীতিকে কীভাবে নিছক ক্ষমতা ও বিত্তের বিনিয়োগে পরিণত করেছে। তাই তারা ওয়েবসাইট তৈরি করে ইস্যুভিত্তিক ও রাজনৈতিক মতামত–নির্বিশেষে একটি ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলে। সেই অরাজনৈতিক নানা বর্ণের প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্ভূত আন্দোলনই আজ অনেক মূল্যের বিনিময়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে স্বৈরাচার উৎখাত করে বিশাল এক প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে। এই প্রাথমিক বিজয়ই ‘রাষ্ট্রক্ষমতা’ অর্থাৎ স্বৈরাচারের বিদায়ের পর কে সেখানে বসবে, সে প্রশ্ন তুলে ধরেছে জাতির সামনে। এ কথা সত্য যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নিজেরা কখনো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হতে চাননি বা চাওয়ার কোনো কথাও ছিল না। সে জন্যই হয়তো তাঁদের প্রতি জনগণের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাই রাস্তায় যখন নিঃস্বার্থ তরুণেরা প্রাণ দিয়েছেন, তখন জনগণও অকুণ্ঠিতভাবে তাঁদের পাশে বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু এত আত্মত্যাগের পর আবার যদি কোনো নতুন সাম্রাজ্যবাদ বা মৌলবাদের আদর্শপুষ্ট ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি বা আরও বৈষম্যপূর্ণ কোনো সরকার এসে শূন্যস্থানে বসে, তাহলে ছাত্রসমাজ ও জনগণের এই গৌরবময় আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সেটিও নিশ্চয়ই ছাত্র-জনতা চাইবে না। তাই রাজনৈতিক প্রশ্নটিকে এখন এই মুহূর্তে ছাত্র-জনতার কিছুটা বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান ডানপন্থা/বামপন্থা/ধর্মভিত্তিক প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলো কি এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় গিয়ে কে কী করবে, এ রকম কোনো কর্মসূচি দিয়েছে? আন্দোলনের ফসল হিসেবে আজ যে অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি হয়েছে, তাদেরও কি কোনো ১০০ দিনের ইতিবাচক কর্মসূচি বা পরিকল্পনা আছে? অন্তর্বর্তী সরকারে তরুণদের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের কাছে কি নিজেদের বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে?
সে রকম কোনো ইতিবাচক কর্মসূচির প্রস্তাব তরুণদের তরফ থেকে কিন্তু কমই দেখা যায়। এখন পর্যন্ত তাঁদের দাবিগুলো তাদের ভাষায় ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’কে তাড়িয়ে ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা’র বিলোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিলোপ বা যেকোনো উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, মৌলবাদী ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা রাষ্ট্রধর্মমতবাদ, অথবা ‘ব্লাসফেমি আইন’ ব্যবহার করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তথাকথিত ‘নাস্তিক’ বা ‘আহমদিয়া’ ট্যাগ দিয়ে নিপীড়ন, ইত্যাদি প্রবণতার রয়েছে মৌলিক বৈরিতামূলক বিরোধ। কিন্তু ইতিমধ্যেই এসব প্রবণতা দেশের ভেতরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে; এ ব্যাপারে কি তাঁরা সচেতন? যদি এ ব্যাপারে তাঁরা সচেতন হন, তাহলে তাঁদের ও তাঁদের সরকারের উচিত হবে কালবিলম্ব না করে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা।
বেশির ভাগ তরুণই তাই যে যে দলই অতীতে করুক না কেন বা যে দলের প্রতি যে আশায়ই সমবেত হন না কেন, বাস্তবে সমস্যা সমাধানের একটি সুনির্দিষ্ট রূপকল্প কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত পাননি। একটি বৈষম্যহীন সমাজে প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য সমাজের কী ধরনের মৌলিক রূপান্তরের প্রয়োজন হবে, তা নিয়ে তরুণদের ও প্রতিযোগী দলগুলোর ধারণা আজও অস্পষ্ট। প্রতিযোগী আদর্শগুলো নিয়ে একটি খোলামেলা বিতর্কও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে হলো না। অন্যদিকে দিগদর্শনবিহীন ছাত্র–তরুণেরা প্রত্যাশিত কর্মসংস্থান না পেয়ে ক্রমেই হতাশার গভীরে নিমজ্জিত হচ্ছিলেন। অন্যদিকে দরিদ্র পিতাদের পক্ষেও বেকার সন্তানদের ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে উঠতে থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ব্যাপকভাবে একটি ’অস্তিত্বের সংকট’।
বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাহ্য বস্তুগত ভিত্তি ছিল এটাই। সাধারণভাবে তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের মূল কথা ছিল, বহু কষ্ট করে গণরুমে থেকে ‘আধাপটা’ খেয়ে আমি পড়াশোনা করে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো ফল করলাম, কিন্তু এখন কোটার কারণে বা রাজনৈতিক আনুকূল্য বা ঘুষের কারণে চাকরিটা অযোগ্য কেউ পেলেন, তখন দেখে–শুনে খেপে না গিয়ে অন্য কোনো উপায় আমার থাকে কি? অথবা আমি স্বশিক্ষিত ছাত্র, ঠিকমতো পড়ার সুযোগ পাইনি, টিউশনি করতে হয়েছে, হলেও ঠিকমতো খাবার পাইনি, ঘুমাতে পারিনি, বহু রাত জেগে মুঠোফোন টিপে আমি নিজে নিজে কিছু শিখে ভালো নম্বর পেয়েছি এবং অবশেষে বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছি; কিন্তু তারপর আরেকজন শুধু মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান বা সন্তানের সন্তান বলে আমাকে অতিক্রম করে যাবেন বা আরও যেটা খারাপ, শাসক দলের অনুগ্রহভাজন বলে অথবা চাচা-নানা–ক্ষমতাসীন দলের নৈকট্যের কারণে এগিয়ে যাবেন, তা হতে পারে না।
অবশ্য প্রতিবন্ধী বা আদিবাসী বা নারী এ রকম পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর সদস্য তরুণেরা হয়তো কিছু বাড়তি কোটা সহানুভূতি পেতে পারেন, এটুকু পর্যন্ত মেধাবী ছাত্ররা মানতে রাজি ছিলেন। অবশ্য আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কোনো কোনো তরুণী বা মুক্তিযোদ্ধার মেধাবী সন্তান যোগ্যতাকেই সম্মানজনক মনে করে কোনো কোটা সুবিধা চাননি, এটাও আমরা দেখেছি। সে জন্যই তাঁদের নৈতিক দাবিটি ছিল ‘কোটা বিলুপ্তি’ নয়, ‘কোটার যৌক্তিক সংস্কার’।
সুতরাং কোটা সমস্যাকে তলিয়ে দেখলে আসল বড় বড় সামাজিক সমস্যাকে চূড়ান্ত বিচারে নানা রকম বৈষম্যের সমস্যা হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়; আর্থিক সক্ষমতার বৈষম্য, দলীয় স্বজনপ্রীতিমূলক সুশাসনের বৈষম্য, হলগুলোয় আবাসনকে কেন্দ্র করে দাতা-গ্রহীতা বৈষম্য ইত্যাদি। কোটার বিলুপ্তি ঘটলে বা সংস্কার করা হলেও এসব সমস্যা রাতারাতি দূর হয়ে যেত না, বরং এসব আনুষঙ্গিক সংস্কারের দাবিও পর্যায়ক্রমে সামনে এসে যেত; যেমন এখনো তা–ই আসছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন দৃশ্যত ক্ষুদ্র ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের আকারে শুরু হলেও এর বিস্ময়কর বিস্তারের বহুমাত্রিক ইতিবাচক সম্ভাবনা ও শক্তি ছিল।
বস্তুগত ভিত্তিসম্পন্ন এই যৌক্তিক আন্দোলনকে যখন বুলেট দিয়ে দমানোর চেষ্টা করা হলো, তখন আর এটা সীমাবদ্ধ থাকল না। একটার পর একটা জায়গা থেকে নির্যাতিত আহত ছাত্ররা দলে দলে এসে যোগ দিতে শুরু করলেন। তাঁদের পবিত্র ক্রোধ তখন জেগে উঠল। আমরা সবাই সেই আবেগ প্রথম দিকে ধরে উঠতে পারিনি। যাঁরা তাঁদের কাছাকাছি থাকতেন, তাঁরা তা বুঝেছিলেন। ফলে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁদের শিক্ষক–মাতা-পিতা-অভিভাবকেরা। আর তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা-সুবিধা-বৈষম্য রক্ষার জন্য অবস্থান নিল ক্ষমতাসীন শাসক দল ও তার পেটোয়া বাহিনী।
এর ফলে আন্দোলনটি পরিণত হলো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত স্তরের ব্যাপকাংশের এক নৈতিক বিদ্রোহে। এই বিদ্রোহের ফলে বর্তমান সরকারের মধ্যবিত্ত সমাজে এযাবৎ অনুসৃত নানা অপকৌশলভিত্তিক (যেমন ঘুষ, দলীয় স্বজনপ্রীতি, আর্থিক বৈষম্য, ভীতি প্রদর্শন, ব্ল্যাকমেইল, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিক্রয় ইত্যাদি) ‘হেজিমনি’ বা আধিপত্যটি অতি দ্রুত খান খান হয়ে ভেঙে গেল।
দেশে চলছিল মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকট। আর এই জুলাই মাসেই সৃষ্টি হয়েছিল চীন-ভারতের তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভূরাজনৈতিক উভয় সংকট। সামগ্রিকভাবে এই সব উপাদানের সমপাতনের ফলে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ বা ফাটলের। এর ফলে স্বৈরাচার একধাক্কায় বিদায় হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আরেকবার প্রমাণিত হলো যে মানুষ যদি মরতে রাজি থাকে, তাহলে তাকে পরাজিত করা যায় না। কিন্তু শূন্যস্থানটি কে কীভাবে পূরণ করে, তার ওপর নির্ভর করবে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সার্থকতা। সুতরাং আজ যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, এখান থেকে রাষ্ট্রকে যদি আমরা উদ্ধার করতে চাই, তরুণ সমাজকে তাদের যথার্থ পাওনা বুঝিয়ে দিতে চাই, তাহলে শুধু তাদের ৮ দফা বা ৯ দফা দাবি মানলে তা পূর্ণ হবে না।
এ জন্য ‘বৈষম্য’ নামক সমস্যার মূলে প্রবেশ করতে হবে। স্বজনতোষণমূলক পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে মুক্ত একটি সমতাভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিছু যৌক্তিক নারী কোটা এখনো রেখে দিতে হতে পারে এবং সেদিক থেকে কিছুটা কল্যাণমূলক অর্থনীতির কথাও ছাত্রনেতারা ভাবতে পারেন। টাকা পাচারকারী ও অতি ধনীদের কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে একটি গণতান্ত্রিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
সর্বাগ্রে কায়েম করতে হবে গণতান্ত্রিক সুশাসন ও থ্রি–এমের (মানি, মাসল, ম্যানিপুলেশন) প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা। সবচেয়ে কঠিন হবে, এই তৃতীয় সমস্যার সমাধান এবং এটিই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো না তৈরি করে তাড়াহুড়ো করে কোনো নির্বাচন করলে তা ফলপ্রসূ হবে না। আবার সেই সুযোগে বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শক্তিকে সুসংগঠিত হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনাটাও কাঙ্ক্ষিত হবে না। একই সঙ্গে আরও খারাপ কোনো মৌলবাদী শক্তি কারও জুনিয়র পার্টনার বা সিনিয়র লিডার হয়ে এই সুযোগে ক্ষমতায় ফিরে আসলে তাতেও দেশের কোনো মঙ্গল হবে না।
তাই ভবিষ্যৎ সমাধানটি ব্যক্তি বা দলবদলের সমাধান নয়, মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান হতে হবে। না হলে তরুণেরা এখন প্রাথমিক এক দফা অর্জনের পর ঘরে বসে থাকলে আসল সমস্যাগুলোর কোনো সুরাহা হবে না। কিছুদিন পর তাঁরা আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন এবং নতুন শাসকেরা অর্বাচীনের মতো গুলি চালিয়ে তা দমন করতে যদি চায়, তাহলে একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হবে। তাই তরুণ ছাত্র সমাজ ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উভয়ই যদি এই মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করে তা সমাধান করতে সচেষ্ট হয়, তাহলেই এবারের আন্দোলন সার্থক হবে। এই আন্দোলনের আশু উপলব্ধিকে তাই দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্বে রূপান্তরিত করতে হবে। আবারও তরুণদের ওপর ভরসা রেখে এই লেখা শেষ করছি।
এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক