মতামত

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ এড়িয়ে যেখানে সফল ভারত

চীনের আগ্রাসী উত্থানের কারণে ভারত ইন্দো-প্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত সংস্থাগুলোয় যুক্ত হয়েছে।
ছবি : রয়টার্স

গত দশকে বৈশ্বিক ভূরাজনীতি একটি অন্তর্বর্তী অবস্থায় পৌঁছায়। এর বড় কারণ হলো, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলটি বিশ্বের ভারকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে এ ধারণা অতিরঞ্জিত হয়ে যাবে, কিন্তু বিশ্ব বহু মেরুকেন্দ্রিক একটা ব্যবস্থার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।

এর প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, আগ্রাসী চীনের ধারাবাহিক উত্থান এবং সে কারণে সৃষ্ট কৌশলগত জটিলতা। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের আধিপত্যের লড়াই যেমন আছে আবার সেই লড়াইকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির ভূরাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভূরাজনীতির পালাবদল ত্বরান্বিত করে তুলেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ মিত্ররা এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু চীন ও ভারত নিরপেক্ষতা দেখিয়েছে।

২০২২ সালের ব্রিকস সম্মেলনে এবং সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে ‘নতুন বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থার’ উত্থান হচ্ছে বলে ঘোষণা দেয়। বিশ্বের অন্যান্য প্রধান ও মাঝারি শক্তির দেশগুলোও বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থার প্রতি তাদের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্বরাজনীতি বদলের ক্ষেত্রে একটা বাঁকবদল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

অন্যান্য বিশ্বশক্তির মধ্যে ভারতকে বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের প্রতি সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতিশীল বলে মনে হয়। একই সঙ্গে ভারত উন্নয়নশীল বিশ্বের শক্তিশালী নেতা হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পরাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে এবং আজকের দিনের বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সহায়তার পথ ধরে ভারত বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগোতে চায়।

পশ্চিমা বিশ্বকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো চীনা ঘরানার বহু মেরু বিশ্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে ভারত। কেননা, এখানে সাম্রাজ্যবাদী ‘চীনের স্বপ্ন’ রয়েছে। দুই মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় ভারতের স্বার্থ কখনোই অর্জিত হবে না। বৈশ্বিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পক্ষেরই লাগাম টেনে ধরতে চায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বহু বছর ধরে পরামর্শ দিয়ে আসা হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিবর্তনকে অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তববাদী রাজনীতির প্রয়োজনে জোটনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বহুমাত্রিক জোটের দিকে পালাবদল—এই আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। সাম্প্রতিককালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পশ্চিম বনাম রাশিয়ার মধ্যকার সংঘাত, এই প্রহেলিকা ভারত যেভাবে মোকাবিলা করছে, তা থেকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির এই অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। চীন-পশ্চিম বিভক্তির মধ্যে নয়াদিল্লি খুব সুনিপুণভাবে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে চলেছে।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত এখন পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন নিয়ে এশিয়ার দেশগুলো বড় ধরনের দ্বিধায় আছে। এ দেশগুলোর জন্য ভারত একটি ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিন্তু রাশিয়া-চীনের মধ্যকার নীরব ও অদৃশ্য প্রতিযোগিতা ভারতের জন্য আলাদা একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ঐতিহাসিকভাবেই রাশিয়া ভারতের বন্ধু, অন্যদিকে চীন প্রতিপক্ষ।

মিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি ঝুঁকে না পড়ে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না হয়ে পররাষ্ট্র সম্পর্কের একটা নজির ভারত স্থাপন করেছে।

চীনের আগ্রাসী উত্থানের কারণে ভারত ইন্দো-প্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত সংস্থাগুলোয় যুক্ত হয়েছে। কোয়াড, কোয়াড প্লাস ও ইন্দো-প্যাসিফিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রোসপারিটি—এ ধরনের ফোরামে ভারতের যুক্ত হওয়ার পেছনে এটিই মুখ্য কারণ। ২০২২ সালে এসে ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভীতি ও বিরোধিতা অনেকটাই বেড়ে যায়। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে ‘কোনো সীমা নেই’ বলে ঘোষণা করে চীন। বেইজিংয়ের এই অবস্থান, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে নীতি তার বিরোধী। কেননা দিল্লি-মস্কো সম্পর্কের ভিত্তি হলো নির্ভেজাল জাতীয় স্বার্থ।

এ ছাড়া পারস্পরিক ভুল-বোঝাবুঝি থেকেও ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত বেড়ে যায়। চীন ভারতের জন্য সর্বপ্রধান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। যত দিন গড়াচ্ছে ততই দৃশ্যমান হচ্ছে এই হুমকিটি চিরস্থায়ী। শুধু সীমানা বিরোধের মধ্যে চীন-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ নেই। সমুদ্রে ভূরাজনৈতিক বিরোধেও সেটা গড়িয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে ভারত যেমন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখছে, ঠিক একইভাবে ত্রিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ফোরামেও যুক্ত হচ্ছে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখা এখন নয়াদিল্লির প্রধান লক্ষ্য। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ভারতের এই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ভারতের দার্শনিক অনুশীলন এবং ‘ভারতের কৌশলগত চিন্তার ধরন’ থেকে এই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন গ্রহণ করা হয়েছে। এটি ভারতের কূটনীতির প্রধান স্তম্ভ।

বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রুতি ভারতের কূটনীতির দ্বিতীয় স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের পর ভারত নিজেদের বিশ্বরাজনীতির প্রধান মেরু হিসেবে বিবেচনা করে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যাদের অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভারত মাঝারি শক্তির রাষ্ট্র রয়ে গেছে এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারেনি। কিন্তু মধ্যম সারির শক্তি হতে ভারত এখন সামনের দিকে এগোচ্ছে এবং প্রথম সারির শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো থেকে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছে।

মিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি ঝুঁকে না পড়ে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না হয়ে পররাষ্ট্র সম্পর্কের একটা নজির ভারত স্থাপন করেছে। ভারতের ভবিষ্যতের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এশিয়ার ঐক্য কেন্দ্রীয় বিষয়। ইন্দো-প্যাসিফিকের মধ্যম শক্তির দেশগুলোকে একত্র করতে ভারত কাজ করছে, যাতে সবাইকে নিয়ে যৌথ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়।

পশ্চিমা বিশ্বকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো চীনা ঘরানার বহু মেরু বিশ্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে ভারত। কেননা, এখানে সাম্রাজ্যবাদী ‘চীনের স্বপ্ন’ রয়েছে। দুই মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় ভারতের স্বার্থ কখনোই অর্জিত হবে না। বৈশ্বিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পক্ষেরই লাগাম টেনে ধরতে চায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বহু বছর ধরে পরামর্শ দিয়ে আসা হচ্ছে।

  • জগন্নাথ পাণ্ডা সুইডেনের ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের স্টকহোম সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স-এর প্রধান
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত