ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ ঘটনায় চীন কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তা নিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ভয়াবহ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগে বেইজিং-মস্কোর পক্ষে থেকে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ‘বন্ধুত্বের কোনো সীমা নেই’ বলে একটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মূলত এই পরিভাষা নিয়েই বিতর্ক করে চলেছেন।
কিন্তু এই পরিভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারে একটা সমস্যা আছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে যেখানে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে চীনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ সম্পর্ক। প্রশ্ন হলো, এটা কি নিছক অনুবাদের ভুল, নাকি চীন ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটা এড়িয়ে গেছে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন গবেষক হিসেবে আমি ঐতিহাসিক দলিলের মধ্যে চীনাদের সঙ্গে রাশিয়ানদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বন্ধুত্ব’ পরিভাষাটি কীভাবে এসেছে, তা খুঁজতে চেষ্টা করেছি। বিচ্ছিন্ন দুই জাতির মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের হদিস মেলে ১৯৪৫ সালে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কমিউনিস্টপূর্ব চীন সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তিটির শিরোনাম—চীনা ও রাশিয়ান দুই ধরনের সংস্করণ পাওয়া গেছে। এর সোভিয়েত সংস্করণের শিরোনাম হলো ‘চীন-সোভিয়েত বন্ধুত্ব ও জোট চুক্তি’। অন্যদিকে, চীনা সংস্করণের নাম ‘চীন-সোভিয়েত বন্ধুভাবাপন্ন ও জোট চুক্তি’।
১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট–শাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা হয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত দুই জাতির মধ্যে অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে এ রকম আরও দুটি চুক্তি সই হয়েছে। প্রথমটি সই হয়েছিল ১৯৫০ সালে। পরেরটি ২০০১ সালে। রাশিয়ার সরকারি দপ্তরের নথিতে প্রথমটির নাম ‘বন্ধুত্ব, জোট ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি’, পরেরটির নাম ‘ভালো প্রতিবেশীসুলভতা, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি’।
১৯৪৯ সালের মধ্যে চীনজুড়ে ৫০টির বেশি সোভিয়েত-বন্ধু সমাজ গড়ে উঠেছিল। সোভিয়েত-বন্ধু সমাজের প্রতি চীনাদের এই উদ্দীপনা ও মোহ খুব দ্রুতই ভেঙে যায়। সেখানকার মানুষ বুঝতে পারে, এই সমাজ আসলে কিসের প্রতিনিধিত্ব করছে। একটা ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সদ্য ক্ষমতায় বসা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যাশা ছিল, চীন-সোভিয়েত সম্পর্কের মাধ্যমে দুই পক্ষই যেন লাভবান হয়।
অন্যদিকে, চীনের সরকারি নথিতে দুটি ক্ষেত্রেই ‘বন্ধুত্ব’ শব্দের স্থলে ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও চীনা ও রাশিয়ানদের মধ্যে সম্পর্কের ধরনে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
এমনকি ২০১৯ সালে একটি বিবৃতিতে বেইজিং দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে একাধিকবার ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। বিবৃতিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার কারণ হলো, এ সময়ে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হয়।
বেইজিংয়ের এই বিবৃতিতে কেবল একবার ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি এসেছে। এসব তথ্য–প্রমাণ থেকে প্রমাণিত হয়, বিষয়টি কোনোভাবেই অনুবাদের ভুল নয়। চীন খুব সুস্পষ্টভাবেই ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্যরেখা টেনেছে।
প্রশ্ন হলো, ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহারে চীনের কেন এত অনিচ্ছা? চীনের কাছে রাশিয়ার বন্ধুত্বের অর্থইবা কী? আমি আমার গবেষণায় খুঁজে পেয়েছি, রাশিয়ানদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব শব্দটি ব্যবহারে অনীহার পেছনে নির্দিষ্ট একটি সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে।
কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করা সোভিয়েত-বন্ধু সমাজের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯২৭ সালে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরের দেশগুলোয় সোভিয়েত মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীলদের একত্র করতে এ ধরনের সংস্থা গড়ে উঠেছিল।
১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিবাদের উত্থান হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী স্থাপিত হয়। এ সময় সোভিয়েত-বন্ধু সমাজগুলো বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং কমিউনিস্ট নয়, এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাব তৈরি করতে চেষ্টা করে। চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক এ ধরনের বন্ধু-সমাজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে।
চীনের ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শহর দালিয়েনে প্রথম এ ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি। সে সময় শহরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রতিষ্ঠার পরেই স্থানীয়দের মধ্যে এই সংস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের মধ্যে চীনজুড়ে ৫০টির বেশি সোভিয়েত-বন্ধু সমাজ গড়ে উঠেছিল।
সোভিয়েত-বন্ধু সমাজের প্রতি চীনাদের এই উদ্দীপনা ও মোহ খুব দ্রুতই ভেঙে যায়। সেখানকার মানুষ বুঝতে পারে, এই সমাজ আসলে কিসের প্রতিনিধিত্ব করছে। একটা ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সদ্য ক্ষমতায় বসা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যাশা ছিল, চীন-সোভিয়েত সম্পর্কের মাধ্যমে দুই পক্ষই যেন লাভবান হয়। তারা আশা করেছিল, বন্ধু-সমাজের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার উপায় শিখতে পারবে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সহসভাপতি লিও শাউচি ১৯৪৯ সালে বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন হলো চীনরে শিক্ষক। চীনের জনগণকে সোভিয়েত জনগণের মতো হতে হবে।’
কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট নেতারা খুব দ্রুতই তাঁদের এ ধরনের মন্তব্য যে ভুল, তা নিয়ে সচেতন হয়ে পড়েন। তাঁদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, সোভিয়েত-বন্ধু সমাজ সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সহযোগিতা দেয়, তার জন্য চীনাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বলে জ্ঞান দেয়।
এ ধরনের বন্ধু–সমাজ প্রায়ই ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন কত মহৎ’ এবং ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন চীনের জনগণকে সহযোগিতা করছে’—এ ধরনের বিষয়ের ওপর আলোচনার আয়োজন করত। চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক যেখানে পারস্পরিকভাবে হৃদ্যতাপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, সেখানে ১৯৫০-এর দশকের শেষে দেখা গেল, সেটা পারস্পরিক ভুল বোঝাপড়ার সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। চীনের নেতারা প্রত্যাশা করতেন, কঠোর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের যে বিজয় তাঁরা অর্জন করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন সেটাকে সমান মর্যাদার চোখে দেখে।
কিন্তু সোভিয়েত নেতারা নতুন প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে সোভিয়েত ব্যবস্থার মধ্যে একটি উপরাষ্ট্রের বেশি কিছু মনে করতেন না। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে রাষ্ট্রীয় সীমানা ও সার্বভৌমত্ব বড় কোনো বিষয় ছিল না। এ ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব সব সময় মস্কোর কাছেই থাকবে—এমনটাই ভাবতেন সোভিয়েত নেতারা।
চীন-রাশিয়া অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহারে বেইজিংয়ের অনীহার পেছনে এ ইতিহাস রয়েছে। এর বিপরীতে ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ শব্দ ব্যবহার করছে, তার কারণ চীন রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন।
এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে চীনের দেওয়া বিবৃতিতে ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে চীন। এটা স্পষ্ট, ইউক্রেনীয়দের প্রতি চীনের সহানুভূতি পশ্চিমাদের থেকে ভিন্ন হবে।
এরিয়েল সাংগুন সিয়ান জাওটং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে