এমপিদের জনবিচ্ছিন্নতা: রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা, না সচেতন সিদ্ধান্ত?

পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা মূলত নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতা হিসেবে। যেকোনো স্থানীয় সমস্যা সমাধানে জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি ভূমিকা না রেখে তা সংসদে তুলে ধরে সাধারণত সেই দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের অধিকাংশ নেতাই পশ্চিমা অভিজ্ঞতা ও তত্ত্বভিত্তিক এই গণতান্ত্রিক ধারণায় প্রভাবিত হয়ে এবং আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর পরামর্শ অনুসরণ করে বহুদিন ধরে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব কেবল সংসদকেন্দ্রিক করার দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই দাবি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত যে পর্যায়েই হোক না কেন, পাশ্চাত্যের তুলনায় এ দেশের জনপ্রতিনিধিরা অনেক বেশি জনঘনিষ্ঠ, যা এ সময়ের নানা জরিপে বারবার উঠে এসেছে। জরিপগুলোর তথ্যমতে, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করেন সংসদ সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নেবেন এবং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবেন। জনগণ এও মনে করেন যে তাঁদের প্রত্যাশা জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়।

জনগণের প্রত্যাশার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব যে তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে পরবর্তী সব কার্যক্রম স্থানীয় উন্নয়নকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।

ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন এবং সেগুলো পূরণেরও চেষ্টা করেন। তাঁদের নির্বাচনী এলাকার মানুষদের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ রাখেন, এলাকায় নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন এবং এলাকার সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ফলে, স্থানীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে তাঁদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা সংসদকেন্দ্রিক ভূমিকা সম্পর্কে তাঁদের অজ্ঞানতার পরিচায়ক নয়, বরং তা বাস্তবপ্রসূত।

২০২৩ সালের শুরুতে দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন (টিএএফ) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সারা দেশে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক জরিপ পরিচালনা করে। জরিপটিতে ১০ হাজার ২৪০ জন বাংলাদেশি নাগরিক অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে নারী ও পুরুষের সংখ্যা ছিল সমান সমান। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, জনপ্রতিনিধিদের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা কী, তাঁদের সম্পর্কে জানাশোনা কেমন এবং তাঁদের কাজ তাঁরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন? যেমন একটি প্রশ্ন ছিল, ‘সংসদ সদস্যদের কাজ কী?’

জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকের পারস্পরিক সম্পর্কের এই বিচ্ছিন্নতা সামগ্রিকভাবে, বিশেষত নির্বাচনের বছরে, বেশ আশঙ্কাজনক। অনভিজ্ঞদের রাজনীতিতে প্রবেশের কারণেই কি এটি ঘটছে? নাকি সংসদ সদস্যদের জনসংযোগে অনাগ্রহ ভোটের ব্যাপারে তাঁদের সার্বিক গুরুত্বহীনতারই প্রকাশ?

উত্তরে বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী বলেন, এলাকার মানুষকে সাহায্য, স্থানীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন, এলাকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, দরিদ্রদের সহায়তা এবং সমাজের কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত থাকাই সংসদ সদস্যদের কাজ। অংশগ্রহণকারীদের ৮৪ শতাংশই এই উত্তরগুলো দেন।

অন্যদিকে, মাত্র ৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী সংসদে নীতিনির্ধারণ ও আইনপ্রণয়ন–সংক্রান্ত ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। আরেক প্রশ্নের উত্তরে ৩০ শতাংশ মানুষ ২০২২ সালে তাঁদের সংসদীয় এলাকায় কোনো না কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিক এবং তাঁদের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ বিচ্ছিন্ন। সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৩৯ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক তাঁদের সংসদ সদস্যদের নাম জানেন (২০১৮ সালের তথ্য), মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এই হার ৪৯ (২০১৭ সালের তথ্য)।

টিএএফ-বিআইজিডি জরিপে আমরা জানার চেষ্টা করেছি, বাংলাদেশের জনগণ সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে কতটা জানেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তাঁদের এলাকার জনপ্রতিনিধিদের নাম জিজ্ঞাসা করা হলে ৭১ শতাংশই সঠিক উত্তর দেন। উন্নত বহু দেশের তুলনায় সংখ্যাটি অনেক বেশি হলেও এখানে লক্ষণীয় যে পূর্ববর্তী বছরগুলার তুলনায় এই হার বেশ কমে এসেছে।

২০১৯ সালের তুলনায় এই হার কমেছে ১১ শতাংশ পয়েন্ট, যেখানে ২০১৭ সালের তুলনায় কমেছে ১৪ শতাংশ পয়েন্ট।

জরিপটিতে উঠে আসা আরও কিছু বিষয় পর্যালোচনা করলে এ ব্যাপারে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ‘আপনার সংসদ সদস্য কি গত এক বছরে আপনার এলাকায় এসেছেন?’—এ প্রশ্নের উত্তরে ৪৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ইতিবাচক উত্তর দেন, ৪৬ শতাংশ নেতিবাচক উত্তর দেন আর ৯ শতাংশ ‘জানি না’ উত্তরটি বেছে নেন। পক্ষান্তরে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে ৭২ ও ৬৪ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, সংসদ সদস্যরা গত এক বছরে তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় এসেছিলেন, ১৮ ও ২৯ শতাংশ বলেছিলেন, সংসদ সদস্যরা তাঁদের এলাকায় আসেননি।

অর্থাৎ দেশের নাগরিকদের মতে, সংসদ সদস্যদের তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বেশ কমে গেছে। এই তিন বছরের তথ্যে ‘জানি না’ উত্তরের হারে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি।

যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘সংসদ সদস্যরা আমার মতো সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন’—এ বক্তব্যের সঙ্গে তাঁরা কতটুকু একমত বা দ্বিমত, তাতে ৫৫ শতাংশ মানুষ একমত পোষণ করেন (যার ২৩ শতাংশ পুরোপুরি আর ৩২ শতাংশ মোটামুটি একমত)। পক্ষান্তরে, ৪২ শতাংশ মানুষ এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন, যার মধ্যে ৩২ শতাংশ মানুষ একেবারে আর ১০ শতাংশ মানুষ আংশিক দ্বিমত পোষণ করেন।

আমরা যদি ২০১৯ সালের তথ্যের দিকে তাকাই, তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন (২৯ শতাংশ পুরোপুরি একমত আর ৩৫ শতাংশ মোটামুটি একমত) আর ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা এ প্রশ্নে দ্বিমত বেছে নিয়েছিলেন (২৪ শতাংশ একেবারে দ্বিমত আর ১১ শতাংশ আংশিক দ্বিমত)।

এখানে লক্ষণীয়, আংশিক দ্বিমতের ভাব দুটি বছরে (২০১৯ আর ২০২২) মোটামুটি এক থাকলেও পুরোপুরি দ্বিমতের হার বেশি পরিবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ, আগের চেয়ে কম মানুষ এখন বিশ্বাস করেন যে জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন। একইভাবে, ‘জনপ্রতিনিধির ব্যাপারে আপনি কতটা সন্তুষ্ট’—এ জিজ্ঞাসার উত্তরে আমরা দেখি, আগের বছরের তুলনায় সন্তুষ্টি কমেছে ৯ পয়েন্টের মতো, অন্যদিকে অসন্তুষ্টি বেড়েছে একই হারে।

এখানে আরও লক্ষণীয় হলো, জরিপটি করা হয়েছিল ২০২২ সালে, অর্থাৎ নির্বাচনপূর্ববর্তী বছরে, যখন নির্বাচন করতে ইচ্ছুক সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ ও কার্যক্রম অন্যান্য বছরের তুলনায় জোরদার করার কথা। জরিপের তথ্যমতে, সেখানে তাঁদের জনসম্পৃক্ততা বরং কমেছে।

জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকের পারস্পরিক সম্পর্কের এই বিচ্ছিন্নতা সামগ্রিকভাবে, বিশেষত নির্বাচনের বছরে, বেশ আশঙ্কাজনক। অনভিজ্ঞদের রাজনীতিতে প্রবেশের কারণেই কি এটি ঘটছে? নাকি সংসদ সদস্যদের জনসংযোগে অনাগ্রহ ভোটের ব্যাপারে তাঁদের সার্বিক গুরুত্বহীনতারই প্রকাশ?

  • সৈয়দা সেলিনা আজিজ ও মির্জা হাসান গবেষক ও শিক্ষক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।