পশ্চিমারা কি আসলেই ফিলিস্তিনে শান্তি চায়?

‘এই গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।’
ছবি: রয়টার্স

গাজায় টানা ২০ দিন ধরে বোমাবৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। তারপরও এই গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।

বহু বছর ধরে আমি পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুবাদে গাজায় ইসরায়েলের বারবার চালানো গণহত্যা, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সহিংস দখলদারি এবং ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে ইসরায়েলের বানানো একদেশদর্শী আইন নিয়ে বহু প্রতিবেদন করেছি। কিন্তু এমন নারকীয় তাণ্ডব আমি কখনোই দেখিনি।

৭ অক্টোবর হামাসের চালানো হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলিরা যে ভয় ও আতঙ্কের সম্মুখীন হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের পাল্টা হামলা হয়তো অনিবার্য ছিল। কিন্তু ইসরায়েল জবাব হিসেবে যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তা সব আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক বিবেচনাপ্রসূত সীমাকে লঙ্ঘন করেছে। ইসরায়েল একটি গণহত্যাকামী প্রবণতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং সেখান থেকে তাকে বের করে আনা খুবই কঠিন হবে।

সম্প্রতি আল-জাজিরাকে দেওয়া ইসরায়েলি ক্যাবিনেট সদস্য মোশে ফিগলিন বলেছেন, এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো পারমাণবিক বোমার ব্যবহার ছাড়াই ড্রেসডেন ও হিরোশিমার মতো গাজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘নররূপী জানোয়ার’ আখ্যা দিয়ে পুরো গাজাকে মুছে ফেলা দরকার বলে বক্তব্য দিয়েছেন। জাতিসংঘের বিবেচনায় বসবাসের অযোগ্য একটি ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৬ বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকা ২৩ লাখ মানুষের বিষয়ে তিনি এই মন্তব্য করেছেন।

‘এই যুদ্ধের নতুন তারকা’খ্যাত ইসরায়েলি গবেষক এলিইয়াহু ইয়োসিয়ান আরও বর্বর মন্তব্য করেছেন। তিনি গাজায় অভিযান চালানো ইসরায়েলি সেনাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রতিশোধের নেশা, শূন্য মাত্রার মানবিকতা ও সর্বোচ্চসংখ্যক লাশ জড়ো করার কথা মাথায় নিয়ে নৃশংসতম রূপ নিয়ে আপনাদের গাজায় ঢুকতে হবে।’

এসব বক্তব্যে স্পষ্টভাবেই গাজাকে একেবারে মুছে ফেলতে বলা হয়েছে। গাজায় যাতে একজন ফিলিস্তিনিও বেঁচে না থাকেন, এ বিষয়ে তাদের সব পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে পশ্চিমারা ইসরায়েলকে থামতে তো বলেইনি, বরং তারা বলছে, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।’ পশ্চিমাদের নীরবতার চাদরের নিচে পড়ে ফিলিস্তিনি শিশুদের সীমাহীন রক্তপাত দেখতে হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েল যাতে তার আকাশ নিরাপদ রাখতে পারে এবং ইসরায়েলি জনগণ নিরাপদ থাকতে পারে, সে জন্য আমরা ইসরায়েলকে পূর্ণমাত্রায় ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা আয়রন ডোম সরবরাহ করে যাব।’

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইসরায়েলের প্রতি ‘অকুণ্ঠ সমর্থন’ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং গাজায় ‘মানবিক বিবেচনায় অভিযান স্থগিত রাখার’ জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে তোলা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকতে ব্রিটেনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক জোট হয়ে যেভাবে আইএসকে মোকাবিলা করেছে, একইভাবে তাদের হামাসকে দমন করতে হবে।

এগুলো পশ্চিমা নেতাদের শত শত আক্রমণাত্মক হুমকির একটি-দুটি উদাহরণমাত্র। তবে ইসরায়েলের এই গণহত্যাকে সমর্থন না করে ভিন্নভাবেও তাঁরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারতেন।

মিডল ইস্ট আইয়ের ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের ব্যুরোপ্রধান হিসেবে গাজার খবরাখবর আমার সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু এই যুদ্ধ চলাকালে আমরা গাজার ভেতরকার তেমন কোনো খোঁজখবরই আনতে পারছি না। যখন ঘটনা ঘটার দিন কয়েক পর তা গণমাধ্যমে আসে, তখন বরাবরের মতোই পশ্চিমারা চুপ করে থাকে। ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো সহায়তা আসে না।

আমার বিশ্বাস ছিল, চীন ও রাশিয়া যেমন মানবাধিকার প্রশ্নে কোনো জবাবদিহির ধার ধারে না, পশ্চিমা সমাজ সে রকম নয়। মানবাধিকার প্রশ্নে তারা একটা সাধারণ বিধি মেনে চলে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু সেটা ভুল। এই যুদ্ধ পশ্চিমের মুখোশ খুলে দিয়ে তাদের সত্যিকার চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। সেই চেহারায় আছে নির্জলা বর্ণবাদ।

পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে সংহতি একটি নির্বাচনমূলক বিষয়। আপনি যদি সাদা চামড়ার মানুষ হন এবং নিহত হন, তাহলে সেটি পশ্চিমের কাছে অগ্রহণযোগ্য। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের ওপর রাশিয়ার হামলায় পশ্চিমারা সমস্বরে নিন্দা করেছে এবং এক হয়ে এর বিরোধিতা করেছে।

অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে সেই পশ্চিমারাই ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যায় নীরব থেকেছে। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি প্রকাশ পেয়েছে। ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেনে ৯ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সামরিক লোক।

অন্যদিকে মাত্র তিন সপ্তাহে গাজায় ৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের প্রায় সবাই বেসামরিক লোক।

পশ্চিমের বার্তা খুব পরিষ্কার, আপনি যদি ফিলিস্তিনি হন এবং নিহত হন, সেটি কোনো বিষয় নয়। আপনার দাম নেই। আপনার নাম ফাতিমা নাকি মিশেল—সেটাই প্রধান ধর্তব্যের বিষয়।

এসব কারণে এটি স্পষ্ট যে, ফিলিস্তিনে অন্তত পশ্চিমাদের হাত ধরে শান্তি আসবে না।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

  • লুবানা মাসারা মিডলইস্ট আইয়ের জেরুজালেমভিত্তিক প্যালেস্টাইন অ্যান্ড ইসরায়েল ব্যুরো চিফ