মতামত

রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দমন ও ‘একতরফা’ নির্বাচন

২৮ অক্টোবর যে সহিংস কর্মকান্ড ঘটেছে, তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েক দিন আগেই।
ছবি : ফাইল ছবি

২৮ অক্টোবর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। এসব সহিংসতার জন্য আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং সরকার সমর্থিত সংবাদমাধ্যমগুলো বরাবরের মতো বিরোধীদের দায়ী করার চেষ্টা করেছে।

অপরদিকে বিরোধীরা এর পেছনে সরকারের ইন্ধন ও পরিকল্পনার কথা বলেছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। এসব বক্তব্য–বিবৃতিতে সাম্প্রতিক এ সহিংসতার জন্য কার দায় কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি রয়েছে।

২৮ অক্টোবর সংঘর্ষ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য ও যুবদল কর্মী নিহত হন। এরপর পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে তিন ডজনেরও বেশি মামলা দেয় এবং তাদের গ্রেফতার শুরু করে। দলটির মহাসচিবসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ইতোমধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে এসব কিছুকে স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়া মনে হতে পারে। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত ‘গায়েবি’ মামলা দায়েরসহ নানারকম আইনি প্রক্রিয়ায় বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন–পীড়ন–হয়রানির বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে এগুলোকে এত সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। এছাড়া এসব ঘটনার কার্যকারণ ও ফলাফল (কজ এন্ড ইফেক্ট) নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। এমনকী কোন পক্ষ সুবিধাভোগী (বেনিফেশিয়ারি) সেটাও বিবেচনাও করা হচ্ছে না। এর ফলে সহিংসতার জন্য কার দায় কতটুকু সেটা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কোন বিষয় নয় কিংবা একপাক্ষিকও নয়। গত প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান দুটি দলই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন সময় সহিংসতাকে কাজে লাগিয়েছে বা ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে সহিংসতার অভিযোগে বিরোধী দল বিএনপিকে কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্য কী হতে পারে? এর উত্তর সম্ভবত: আরো একটি ‘একতরফা’ নির্বাচন।

২.

২৮ অক্টোবর যে সহিংস কর্মকান্ড ঘটেছে, তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েক দিন আগেই। বিএনপির পাল্টা একই দিনে আওয়ামী লীগের সমাবেশের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এর শুরু। এরপর লগি, বইঠা, লাঠি নিয়ে আসা বা রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা কিংবা ‘শাপলা চত্বরের চেয়ে করুণ পরিণতি হবে’–এসব বক্তব্যের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সহিংসতার ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। এক্ষেত্রে প্রস্তুতিরও যে কোন ঘাটতি ছিল না, রাস্তায় প্রকাশ্যে লাঠি হাতে তাদের মিছিল বা মহড়া দেখে তেমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে এগুলোকে সমর্থন করা হয়েছে এবং অব্যাহত রাখতেও বলা হয়েছে।

বিরোধীদের অভিযোগ, ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের বিষয়টি ছিল ‘পূর্ব–পরিকল্পিত’। কারণ, এ সংঘর্ষের সূত্র ধরেই বিএনপির সমাবেশটি পন্ড করে দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন দমনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বিরোধীদের এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার কোন উপায় নেই। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) বিবৃতিতেও এমন ইঙ্গিত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ রড, লাঠি, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করেছে বলে খবর রয়েছে। এ ছাড়া তারা দেশজুড়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি, নির্বিচার আটক এবং নেতা–কর্মীদের পরিবারের সদস্যসহ শত শত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।’ (সরকারকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান, প্রথম আলো ১ নভেম্বর ২০২৩)

২৮ অক্টোবর যে সহিংসতা হয়েছে তার এক পক্ষে ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা, আরেক পক্ষে পুলিশ। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের ‘সহযোগী’ হিসেবে থাকলেও তারা মূল ভূমিকায় ছিলেন না। পুলিশ ও আাওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে এ ‘সহযোগিতার’ বিষয়টি এর আগেও দেখা গেছে এবং স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন। (পুলিশকে সহযোগিতা করতেই মাঠে নেমেছিলেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আজকের পত্রিকা, ২৯ জুলাই ২০২৩)। লক্ষণীয় বিষয় হলো, পুলিশকে বিএনপির ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে মাঠে হাজির করানোর মাধ্যমে দলটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া খুব সহজ হয়েছে।

৩.

আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে ২৮ অক্টোবর সংঘটিত সহিংসতার দায় এককভাবে বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে–এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণেও তা উঠে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গত ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক বিক্ষোভের ওপর পুলিশ অহেতুক শক্তি প্রয়োগ করেছে। সব পক্ষ সহিংসতায় অংশ নিলেও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপরই ধরপাকড় চালানো হচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ১ নভেম্বর ২০২৩)।

শুধু আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা ক্ষমতাসীন দল নয়, সরকার–সমর্থক সাংবাদিক এবং বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমও সহিংসতার জন্য বিএনপিকে একতরফাভাবে দায়ী করেছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশস্থল থেকে একটু দূরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মারধোরের শিকার হন। এই ঘটনায় সরকারপন্থি সাংবাদিকরা বিএনপিকে দায়ী করে বক্তব্য দেন। (সাংবাদিকদের ওপর হামলা, বিএনপিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার আলটিমেটাম, প্রথম আলো, ৩০ অক্টেবর)।

এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘২৮ অক্টোবর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারকদের বাসভবনে হামলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সেদিন আনুমানিক ৩০ সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়েছে। এসব হামলায় বিক্ষোভকারীরা ছাড়াও মোটরসাইকেলে আসা মুখোশ পরা একদল ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন, যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ (সরকারকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান, প্রথম আলো ১ নভেম্বর ২০২৩)

সহিংসতা নিয়ে সরকারপন্থি সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার বক্তব্যের মধ্যে এ পার্থক্য কেন? এ ঘটনাকে অনিচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাপ্রসূত বলার কোন সুযোগ নেই। তাহলে এটা কি দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ?

৪.

সহিংসতার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা হলেও এতে সরকারি দল ও আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কী তা নিয়ে তেমন কোন আলোচনা নেই। এক্ষেত্রেও বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমও ‘নীরব’। এতে সহিংসতা নিয়ে একটি একপাক্ষিক ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি হয়েছে। এটা বিরোধীদের কঠোরভাবে দমনের একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।

২৮ অক্টোবর সংঘর্ষ ও সমাবেশ পন্ড হওয়ার পর বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পরদিন হরতাল ও পরে অধরোধের কর্মসূচি দেওয়া হয়। এই হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও সরকারি দলের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপির কমপক্ষে ৬ নেতা–কর্মী নিহত হয়েছেন। এছাড়া পুলিশের তল্লাশির সময় অসুস্থ হয়ে দলটির এক নেতার স্ত্রীও মারা গেছেন। (ফরিদপুরে বিএনপি নেতার বাড়িতে পুলিশের তল্লাশি, অসুস্থ হয়ে স্ত্রীর মৃত্যু, প্রথম আলো, ২৯ অক্টোবর ২০২৩)।

২৮ অক্টোবর পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই ঘটনায় মামলা হয়েছে, বেশ কয়েজনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীরা নিহত হলেও তা নিয়ে কোন আইনি পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। এর ফলে এসব প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশ বা আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে কি–না, এমন প্রশ্নও উঠছে।

৫.

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কোন বিষয় নয় কিংবা একপাক্ষিকও নয়। গত প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান দুটি দলই তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিভিন্ন সময় সহিংসতাকে কাজে লাগিয়েছে বা ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে সহিংসতার অভিযোগে বিরোধী দল বিএনপিকে কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্য কী হতে পারে? এর উত্তর সম্ভবত: আরো একটি ‘একতরফা’ নির্বাচন।

মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক