ইউক্রেনকে দুর্বল করতে অপরাধীদের যেভাবে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া

ইউক্রেনের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা অস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার করছে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতাকে ধারাবাহিকভাবে নষ্ট করছে।
ছবি : রয়টার্স

গত ১ নভেম্বর ফিনল্যান্ডের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের উপপরিচালক সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমা অস্ত্র চোরাচালান হয়ে ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে চলে যাচ্ছে। এর আগে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপরাধ বাড়ার ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ফিনল্যান্ড কর্তৃপক্ষের সতর্কবার্তা থেকে এ বিষয়টাতে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর ইউক্রেনে সংঘবদ্ধ অপরাধ ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছিল। বেসরকারিকরণের যে ত্রুটিপূর্ণ কর্মসূচি সেখানে নেওয়া হয়েছিল, তার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে এসব অপরাধী গোষ্ঠী প্রচুর সম্পদের মালিক বনে যায়। সোভিয়েত পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তাতে সশস্ত্র এসব অপরাধী গোষ্ঠীর অনেকে ইউক্রেনের বাহিনীগুলোতেও নিযুক্ত হয়েছিল।    

১৯৯০–এর দশকে রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সৃষ্টি হওয়া রাষ্ট্রগুলোয় একই চিত্র দেখা যায়। কিন্তু ২০০০ সালে রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর রাশিয়ায় একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলেন এবং অনেকগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীকে দমন করেন। তবে ক্রেমলিন এসব গোষ্ঠীকে সমূলে নির্মূল করার পথ নেয়নি। রাশিয়া আবার ১৯৯০–এর দশকের অস্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে যাবে কি না, সেই আশঙ্কায় পুতিন তাঁর ক্ষমতাকে সংহত করেছেন।কিন্তু রাশিয়ার সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠী একটি ক্ষেত্রে মস্কোর জন্য অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর চোরাচালান নেটওয়ার্ক ও অবৈধ অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল মুনাফা করার সুযোগ পায় ক্রেমলিন। এ জন্য এসব গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করে ক্রেমলিন এবং তাদের সম্পদ ও ব্যবসার সুরক্ষা দেয়।

সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও ক্রেমলিন নানাভাবে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ইউক্রেনে দক্ষিণ–পূর্ব অঞ্চল এ ধরনের অপরাধী গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় আখড়া। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন দশকের পর দশক ধরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ক্রিমিয়ার অনেক শৌখিন পণ্যের ব্যবসা রাশিয়ার অপরাধী গোষ্ঠীর কারণে টিকে আছে।

ইউক্রেনের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা অস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার করছে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতাকে ধারাবাহিকভাবে নষ্ট করছে। এর পেছনে রাশিয়া সরকারের স্বার্থ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেন থেকে পাচার হওয়া অনেক অস্ত্র ইউরোপে গিয়ে পৌঁছেছে। গত কয়েক দশকে পূর্ব ইউরোপ থেকে পাচার হওয়া অস্ত্র দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ইউক্রেন, ক্রিমিয়ার অপরাধীদের সঙ্গে সংযোগ

পুতিনের শাসন শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনে সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড বেশ বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের তারবার্তা থেকে জানা যাচ্ছে, ক্রিমিয়ার অপরাধী গোষ্ঠী ১৯৯০–এর দশকের চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা। এখন আর তারা রাস্তার মাস্তান নয়। প্রকাশ্যে ব্যবসা–বাণিজ্য যেমন করছে, আবার স্থানীয় সরকারেরও অংশীদার হয়েছে।

অপরাধী গোষ্ঠীর এই রূপান্তরের কারণে ২০১৪ সালে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ক্রিমিয়া প্রবেশ করলে খুব সহজেই তারা সেখানকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। রাশিয়াপন্থী অনেক রাজনীতিবিদ ক্রিমিয়ার আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সের্গেই অক্সোনভ ও স্পিকার ভ্লাদিমির কনস্তানিভও আছেন। সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সন্দেহজনক মৈত্রী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে স্থানীয় সংস্থাগুলোর দুর্বলতা ও ব্যাপকমাত্রায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় সেখানকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীগুলো চলে এসেছে। ক্রিমিয়া দখলের পর ওই অঞ্চলটিতে রাশিয়া প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে। এ যুদ্ধের জন্য যে বাহিনী গড়ে ওঠে, সেখানে দনবাসের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো থেকে জনবলের জোগান আসে। ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিবেশী অঞ্চল থেকেও যোদ্ধাদের ভাড়া করা হয়।

ক্রিমিয়া ও দনবাসে প্রক্সি বাহিনীর ব্যাপক অস্তিত্ব থাকার পরও রাশিয়া–সমর্থিত অনকে অপরাধী গোষ্ঠী ইউক্রেন ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ২০১৯ সালে আমার সঙ্গে আধুনিক রাশিয়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বুলগেরিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তা মার্ক গ্যালোটির আলাপ হয়েছিল। আলাপচারিতায় তিনি আমাকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন, বুলগেরিয়ার ভার্না বন্দর থেকে ইউক্রেনের ওদেসা বন্দরে মাদক ও নকল পণ্য কীভাবে চোরাচালান হয়। এ কাজে রাশিয়ার অপরাধী গোষ্ঠীর পক্ষে ইউক্রেনীয়রা কাজ করে।

ফেব্রুয়ারি মাসে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটনের হুমকি অনেক বেড়ে গেছে। যেকোনো সংঘাত রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করে, সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ পায়। ইউক্রেনকে এবং দেশটির যুদ্ধ করার সামর্থ্যকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য ক্রেমলিন এখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

পশ্চিম ইউরোপে যে বিপদ

ইউক্রেনের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা অস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার করছে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতাকে ধারাবাহিকভাবে নষ্ট করছে। এর পেছনে রাশিয়া সরকারের স্বার্থ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেন থেকে পাচার হওয়া অনেক অস্ত্র ইউরোপে গিয়ে পৌঁছেছে। গত কয়েক দশকে পূর্ব ইউরোপ থেকে পাচার হওয়া অস্ত্র দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে।

পশ্চিম ইউরোপের বাইরে ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় কড়াকড়ি ধরনের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন নেই। এ সুযোগে সেখানকার অনেক জায়গায় অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। বলকান অঞ্চলে সংঘাতের পেছনে এসব অস্ত্রের ভূমিকা রয়েছে। এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল, মালদোভার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ট্রান্সনিসট্রিয়া থেকে ইউক্রেনে মস্কোর মিত্রদের কাছে অস্ত্র চোরাচালানের চেষ্টা করছে। নিষেধাজ্ঞা থাকায় চোরাচালানিরা রাশিয়ার জন্য এ পথেই অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে আসছে।

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পর ক্রেমলিন অপরাধমূলক ব্যবসা–বাণিজ্য থেকে মুনাফা করার দিকে ঝুঁকেছে।

জাতিসংঘের ইন্টার রিজোনাল ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিস ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের একজন ব্যক্তিকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, ইউক্রেনের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে রাশিয়ার ব্যবসায়ীদের লেনদেনে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি।

কয়েক মাস আগে ইউক্রেনের ওদেসা বন্দর ছাড়ার আগে ধাতব পদার্থবাহী একটি জাহাজ আটকে দেওয়া হয়েছিল। এই জাহাজটি রাশিয়ার জন্য অবৈধ পণ্য বহন করছিল বলে ধারণা করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে অবৈধভাবে আসা তামাকের একটা বড় চালান আটকে দেয় বেলজিয়ামের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। লাভজনক এই তামাক চোরাচালানের পেছনে রাশিয়া ও বেলারুশের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। নিষেধাজ্ঞার মুখে বিকল্প পথে অর্থ আয়ের উৎস হিসাবে তামাক চোরাচালানের মতো লাভজনক পথ বেছে নিয়েছে তারা। একইভাবে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে রাশিয়া ও বেলারুশ।
ইউরোপীয় দেশগুলোর গোয়েন্দাদের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে আফগানিস্তান থেকে মধ্য এশিয়া ও রাশিয়া হয়ে ইউরোপে মাদকের চোরাচালানও বেড়েছে।

সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এই সম্পর্কই রাশিয়ার অর্থনীতি ও দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ সক্ষমতার রক্ষাকবচ। যত দিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে ক্রেমলিন তত দিন এ নীতি বজায় রেখে চলবে।

  • জন পি রুয়েল স্ট্র্যাটেজিক পলিসির প্রদায়ক সম্পাদক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে