নদীর বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি। অক্সিজেনও তাজা। চরে কিংবা নদীর পাড়ে দীর্ঘ সময় হাঁটলেও ক্লান্তি ভর করে না।
নদীর বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি। অক্সিজেনও তাজা। চরে কিংবা নদীর পাড়ে দীর্ঘ সময় হাঁটলেও ক্লান্তি ভর করে না।

মতামত

ঈদ উৎসবে নদীও পর্যটনের ঠিকানা হয়ে উঠছে

দু–চার বছর আগেও ঈদ উৎসবগুলোতেও চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রপাড়ে লোকসমাগম তেমন থাকত না। নদীর পাড়ে যাঁদের বাড়ি, তাঁরা হয়তো নদীর টানে কিছুক্ষণ পার করে আসতাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একদম ভিন্ন। নদীর পাড় ধরে যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। বসার জায়গা নেই, তবু হাঁটছে। নৌকাভর্তি হয়ে লোকজন চরে চরে ঘুরছে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন যেন হামলে পড়েছে। কেন?

নদীর বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি। অক্সিজেনও তাজা। চরে কিংবা নদীর পাড়ে দীর্ঘ সময় হাঁটলেও ক্লান্তি ভর করে না। ছবিও বেশ সতেজ হয়ে ওঠে। আগে ফেসবুক ছিল না বলে ছবি তোলার তাগিদ, স্মৃতি সংরক্ষণের আকাঙ্ক্ষাও তেমন ছিল। তা ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের মতো বিশাল নদ, যেখানে সারা বছর পানি থাকে, তার প্রতি টান থাকবে এটা স্বাভাবিক।

সমুদ্রের পানিতে ক্লান্ত হলে আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখ ধোয়া যায় না। ক্লান্তি জুড়ায় আসলে নদীর পানিতেই। অথচ এই ব্রহ্মপুত্রকে নিয়ে, শুধু ব্রহ্মপুত্র কেন, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদ–নদীর পাশে বসার মতো আয়োজনই নেই।

৫০–৬০টি কংক্রিটের বেঞ্চ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বানিয়ে দিলে একটা গণপরিসর তৈরি হয়ে যেত।

দুই.

একটি শহরের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে সেখানকার গণপরিসরে কার্যক্রম কতটা ও কীভাবে সংগঠিত হবে। হাঁটা, দাঁড়ানো, বসা, দেখা, শোনা এবং কথা বলার জন্য যদি জায়গাগুলো আকর্ষণীয় হয়, তাহলে খেলাধুলা, গল্প করা ও প্রতিবেশীদের মেশার সুযোগ বৃদ্ধি পায়।

বলা হয়, বাড়ির বাইরে অধিক সময় কাটানোর সুযোগ একটি আদর্শ শহরের বৈশিষ্ট্য। একটি শহরে বাড়ি ও গণপরিসর (যেমন রাস্তা ও মাঠ) মাঝামাঝি কিছু একটা থাকতে হয়। সেগুলো হলো পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক মাঠ, পুকুর ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে পাড়ার এজমালি সম্পত্তি, এগুলোকে কেন্দ্রে রেখেই পাড়া বা মহল্লা গড়ে ওঠে। বিকেল ও বিশেষ উৎসবে এই জায়গাগুলোকে ঘিরেই খেলাধুলা, হাঁটা, বসা ও সামাজিক কাজকর্ম চলে।

একটি শহর কতটা সভ্য, সংস্কৃতিমান, আধুনিক ও জনগণের, তা বোঝা যায় তার গণপরিসরের সংখ্যার ওপর। পাড়ার মতো শহরের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তবে পাড়ার মাঠটি পাড়ার বাসিন্দাদের উপযোগী, তেমনি শহরেরটিও হতে হয় শহরের জনসংখ্যা ও তার বৈচিত্র্যের ওপর। যেমন চিলমারী, কুড়িগ্রাম শহরের লাগোয়া প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা। এখানে গণপরিসর গড়ে উঠবে এই নদ–নদী দুটোকে কেন্দ্র করে।

যারা নদ–নদীকে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের অংশ ও প্রশান্তির উৎস হওয়ার বিপক্ষে, তারাই ক্ষমতার অংশ। তারা বালু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তারাই নদীর দখলদার। ফলে নদ–নদী ও চর যে পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, তা করবে কারা? কারণ, পর্যটনে আয়ের উৎস সৃষ্টি হয় বেশি লোকের আর বালু ব্যবসায় হয় কয়েকজন ক্ষমতাবানের। আমরা তো অধিক উন্নয়ন আর কম গণতন্ত্র চাই।

ইয়ান গেল নামের একজন ডেনিশ স্থাপত্যশিল্পীর একটি ধ্রুপদি গ্রন্থের নাম ‘লাইফ বিটুইন বিল্ডিংস’। সেখানে তিনি জীবন ও স্থাপত্যের মধ্যে সংযোগের প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেছেন। দেখিয়েছেন, কীভাবে সহাবস্থানের মাধ্যমে যোগাযোগের সূচনা হয়। কীভাবে স্থানভেদে যোগাযোগের সম্ভাবনা, পূর্বপরিচয় রক্ষার সুযোগ, সামাজিক পরিবেশগত তথ্য, অনুপ্রেরণার উৎস, উৎসাহব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা, কার্যকলাপের আকর্ষণ (যেমন খেলাধুলা ও বিভিন্ন কার্যকলাপের অভ্যাস), কার্যকলাপ এবং রক্ষার অধিকার, পথচারীদের চলাচলে আকর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে শহরবাসীর সম্পর্ক নির্মিত হয়।

ইয়ান গেল অবকাঠামোর প্রভাবে যোগাযোগের সম্ভাবনা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার পাঁচটি কারণ দেখিয়েছেন। দেখা ও শোনার বেলায়—১. দেয়াল, ২. অধিক দূরত্ব, ৩. উচ্চগতি, ৪. বহুতল ও ৫. বিপরীতমুখিতা—এগুলো যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

গণপরিসরে বিশেষত্বই হচ্ছে, যেখানে লোকজন সহজেই সমবেত হতে পারে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও বিনোদনমূলক ঘটনা সংঘটিত হয়। যেখানে মানুষে মানুষে যোগাযোগের, আড্ডার কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান।

অথচ বাংলাদেশের সর্বত্র গণপরিসরগুলো গ্রিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, নিষিদ্ধ হয়েছে আড্ডা ও যেকোনো সমাবেশ। রংপুরের পায়রা চত্বর, ঢাকায় সংসদ ভবন কিংবা ছবির হাট।

তিন.

আশ্চর্য সত্য, যেখানে জনসমাগম থাকে, সেখানে দুর্ঘটনা হওয়ার বদলে উল্টো তা কম হয়। নদীর পাড়ে মানুষ বিশ্রাম ও শান্তি নিতে গেলে বালু উত্তোলনের শব্দ বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বালু উত্তোলন বিরোধিতাসহ নদী রক্ষার আন্দোলনে তারাই যুক্ত হয়, যারা নদ–নদীর পাড়ে মানসিক প্রশান্তি পেয়েছে।

ইতিহাসে শহরগুলো গড়েই উঠেছে গণপরিসরগুলাকে কেন্দ্র করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যও তা-ই, জনগণকে বাড়ির বাইরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে বেশি বেশি করে যুক্ত রাখতে ভূমিকা নেওয়া। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সমাজের যত বেশিসংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও অপরিহার্য, ততই ভালো।

যারা নদ–নদীকে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের অংশ ও প্রশান্তির উৎস হওয়ার বিপক্ষে, তারাই ক্ষমতার অংশ। তারা বালু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তারাই নদীর দখলদার। ফলে নদ–নদী ও চর যে পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, তা করবে কারা? কারণ, পর্যটনে আয়ের উৎস সৃষ্টি হয় বেশি লোকের আর বালু ব্যবসায় হয় কয়েকজন ক্ষমতাবানের। আমরা তো অধিক উন্নয়ন আর কম গণতন্ত্র চাই।

  • নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge1@gmail.com