মতামত

ভাগনার বিদ্রোহ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামনে যে সুযোগ নিয়ে এসেছে

ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপ সম্মতি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে
ছবি : রয়টার্স

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে বিশ্বের প্রধান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক ক্ষমতা ও প্রভাব ভাগাভাগি চলছে। রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ একটি ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। ফলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আগে থেকে তারা যে কৌশলনীতি অনুসরণ করে আসছিল, তার পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

এর কারণ তিনটা। প্রথমত, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের বিদ্রোহ। ভাগনার গ্রুপের অনেক সদস্য এখন বেলারুশে। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে ভাগনার গ্রুপের সেনারা রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কার্যকর উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আফ্রিকার ছয়টি দেশে তারা ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করছে।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার দিকে চীনের ঝুঁকে পড়া।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ফু ছং বলেন, রাশিয়া ও ইউরোপের দুইয়ের জন্য চীনের সমর্থনটা ‘সীমাহীন’। ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে নতুন দেশগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তাদের একটাও পূর্ণ স্বাধীন নয়। কেননা, কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে তারা সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বলেছেন, রাশিয়া আগ্রাসনের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাতে সমর্থন করা ছাড়া চীন ‘প্রধান রাজনৈতিক খেলোয়াড়’ হতে পারবে না।

এ ঘটনাগুলো উল্লেখ করার কারণ হলো, পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায় পররাষ্ট্রনীতি এক জায়গায় স্থির নেই।

এটা করা গেলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও তাঁর অনুসারীদের জন্য সেটা হবে ম্যাকিয়াভেলির সূত্র অনুসারে ধ্রুপদি ভূরাজনীতির দৃষ্টান্ত। চীনের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনে যদি একটা যুদ্ধবিরতি হয়, তাহলে নতুন একধরনের অনিশ্চয়তা যেমন তৈরি হবে আর তাতে বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনও ঘটবে।

প্রিগোশিনের নেতৃত্বে বিদ্রোহের পর আফ্রিকার দেশগুলোতে থাকা ভাগনার সেনাদের নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকা মহাদেশে বিনিয়োগ করে চীন ভবিষ্যৎ মুনাফা করতে পারে। একই সঙ্গে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মহাদেশটিতে তাদের হারানো প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে।
অনেক কৌশলবিদ মনে করেন, এই আলোচনা এখন উঠছে এর কারণ হচ্ছে, সমর নেতা হিসেবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাবমূর্তিতে চিড় ধরেছে। সেভাস্তোপল বন্দর ও জর্জিয়াকে রাশিয়ার কবজায় নিয়েছেন পুতিন। ফলে বাল্টিক দেশগুলোতে সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। নিশ্চিতভাবেই এটা পুতিনের বিচক্ষণতার নমুনা।

বিদ্রোহের সময় ক্রেমলিনের উদ্দেশে ভাগনার সেনাদের যাত্রার সময় পুতিনের পক্ষে রাশিয়ানদের সমর্থন খুব বেশি পাওয়া যায়নি। এর কারণ হলো, ইউক্রেন যুদ্ধে তাঁর ব্যর্থতা।

আফ্রিকা মহাদেশে ভাগনার সেনারা পা রাখার কারণে সেখানে সূক্ষ্ম সমস্যার জন্ম দিয়েছে। পুতিনের নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো ভাগনারকে অর্থায়ন করত। এখন তার প্রায় সবটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আফ্রিকা এখনো অর্থনৈতিক সুযোগের ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনার মহাদেশ। বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তিগুলোর জন্য এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, আফ্রিকার মানুষদের সঙ্গে তাদের ‘ভালো আচরণ’ করতে হবে।

আফ্রিকা মহাদেশের সোনা, হীরা, মূল্যবান সম্পদ, কাঁচামাল আহরণ করতে বিনিয়োগ, সামরিক ও বাণিজ্য চুক্তি কিংবা নতুন কোনো উপায় প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন করতে গেলেও সেটা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, চীনের পররাষ্ট্রনীতি প্রণেতারা মনে করেন এগুলো নব্য-উপনিবেশবাদী আচরণ। আফ্রিকা মহাদেশে চীনকে যদি তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে ভাগনার গ্রুপকে বেনামে অর্থায়ন করতে হবে।

সাম্প্রতিক কালে দুই পরাশক্তির মধ্যে যে ধরনের বৈরিতামূলক আচরণ দেখা গেছে, তাতে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আগ্রাসী ও বৈরীমূলক। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ভালো করে বিবেচনা করতে হবে, ভাগনার গ্রুপের প্রতি বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কের কারণে চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে কতটা লাভবান হতে পেরেছে।

২০০৯ সালেই যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে চীন আফ্রিকা মহাদেশের প্রধান বিনিয়োগকারীতে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে তারা মহাদেশটির প্রধান প্রভাবশালী শক্তি।

একটা বিষয় হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ঘিরে থাকা কট্টর কিন্তু বোকা বিশেষজ্ঞরা সূক্ষ্মভাবে ও দীর্ঘ মেয়াদে কিছু ভাবছেন না। তাঁরা চীনবিরোধী নীতি নিয়েই এগোচ্ছেন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্য উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে, এমন যেকোনো ধারণার বিরোধিতা তাঁরা করেন। চীনকে রাজি করিয়ে রাশিয়াকে চাপ দিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি হোক, সেটা তাঁরা চান না।

রাশিয়া থেকে অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার কারণে আফ্রিকায় ভাগনার গ্রুপকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে গোপনে চীনকে সহায়তা করতে হবে। যদিও সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হবে বিরক্তিকর কাজ। এই সহযোগিতার স্বীকৃতি হিসেবে চীনকে কিছু ছাড় দিতে হবে। অন্ততপক্ষে ইউক্রেনে আগ্রাসনের কাজে ব্যবহৃত হয়, রাশিয়াকে এমন সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

ইউক্রেনে কোরিয়ার মতো একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করতে মধ্যস্থতা করতে পারে চীন। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের ওপর কিছুটা প্রভাব তৈরি করতে পারবে বেইজিং।

আন্তর্জাতিক পরিসর থেকে এখন চীন যে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছে, তার অবসান হবে এবং বাণিজ্য সম্পর্কের সুযোগ তৈরি হবে।

এটা করা গেলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও তাঁর অনুসারীদের জন্য সেটা হবে ম্যাকিয়াভেলির সূত্র অনুসারে ধ্রুপদি ভূরাজনীতির দৃষ্টান্ত। চীনের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনে যদি একটা যুদ্ধবিরতি হয়, তাহলে নতুন একধরনের অনিশ্চয়তা যেমন তৈরি হবে আর তাতে বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনও ঘটবে।

  • টম জে ভেল্ক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত