কদিন পরপরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হচ্ছে। কখনো ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড ও দলীয় কোন্দল নিয়ে, আবার কখনো উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে।
বলা যায়, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অনেকটা প্রকাশ্যেই এই আলোচনা হয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অরাজক পরিস্থিতির মূলে হচ্ছেন উপাচার্য শিরীণ আখতার। তাঁর দায়িত্বকালে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে, কিন্তু সেই পাহাড়ে তেমন টোকা দিতে পারেননি তিনি। বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ক্যাম্পাসটির পাহাড় সবচেয়ে বেশি উজাড় ও ধ্বংস হয়েছে এ সময়টাতেই।
এ মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বড় কয়েকটি ঘটনা নিয়ে আলোচনা তৈরি করেছে। শাটল ট্রেনে দুর্ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থীর গুরুতর আহত হওয়া ও সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী আন্দোলন; সেই আন্দোলনকে বেহাত করে দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে উপাচার্যের বাসভবন ও পরিবহন দপ্তরে ব্যাপক ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো, যার পেছনে ছিল মূলত চাঁদাবাজি; এরপর গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের দুই পক্ষ ধারালো অস্ত্র দিয়ে সংঘর্ষে জড়ানো, যদিও এ ধরনের সংঘর্ষ একধরনের ‘রুটিন ওয়ার্কে’ পরিণত হয়েছে ক্যাম্পাসটিতে। সংঘর্ষের দুইদিন পরেই গত রোববার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আলোর প্রতিনিধি শাহ মোশাররফকে ছাত্রলীগের বেধড়ক মারধর করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর যখন-তখন চড়াও হওয়া যেন ছাত্রলীগের ‘অধিকার’। কিন্তু তাদের এই অধিকার কে দিয়েছে? নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেই, আর সেখানে তো উপাচার্যই সর্বেসর্বা। এত অপকর্ম করেও ছাত্রলীগের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীরা বারবার ছাড় পেয়ে যান। উপাচার্য যেন দিনের পর দিন ‘মায়ের আদর’ দিয়ে আগলে রেখেছেন তাঁদের। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একাডেমিক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কদিন পর স্পষ্ট হয়, তা ছিল নামকাওয়াস্তে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বারবার আঙুল উঠেছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ ও পাল্টাপাল্টি অবস্থানও তৈরি হয়েছে। সেসব দুর্নীতি ও অনিয়ম মসৃণভাবে চলতে দিতেই কি ছাত্রলীগকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়া? ক্যাম্পাসে সরকারি ছাত্র সংগঠনের মাস্তানতন্ত্রের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরাচারি পরিবেশ তৈরিতে যে উপাচার্যের নামটা ঘুরে–ফিরে সর্বমহলে আলোচনা হয়, তা কি তিনি জানেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বারবার আঙুল উঠেছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ ও পাল্টাপাল্টি অবস্থানও তৈরি হয়েছে। সেসব দুর্নীতি ও অনিয়ম মসৃণভাবে চলতে দিতেই কি ছাত্রলীগকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়া? ক্যাম্পাসে সরকারি ছাত্র সংগঠনের মাস্তানতন্ত্রের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরাচারি পরিবেশ তৈরিতে যে উপাচার্যের নামটা ঘুরেফিরে সর্বমহলে আলোচনা হয়, তা কি তিনি জানেন?
প্রথম আলো প্রতিনিধিকে মারধরের ঘটনায় ছাত্রলীগ কমিটিকে বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে নানা অরাজকতা তৈরির পেছনে বারবার নাম উঠে আসে সেই কমিটির সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর। রুবেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১৭ বছর আগে। টিপু ভর্তি হয়েছিলেন ১২ বছর আগে। সহসভাপতি নাছির উদ্দিন ১৩ বছর আগে, সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ ১২ বছর আগে ভর্তি হন।
অন্যদিকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু মুন্সী, সাইদুল ইসলাম, শামসুজ্জামান চৌধুরী, সহসভাপতি মইনুল ইসলাম, আবু বকর তোহা ভর্তি হন ১১ বছর আগে। অছাত্র এসব ‘আদু ভাই’ হলের একেকটি কক্ষ দখল করে রেখে নিজেদের ‘স্বর্গরাজ্য’ তৈরি করে রেখেছিলেন। এসব ছাত্রলীগ নেতা ও তাঁদের অনুসারীদের অপকর্মের নানা তথ্যপ্রমাণ ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকলেও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে।
প্রথম আলোতে এসব নিয়ে বারবার প্রতিবেদন করে আসছিলেন মোশাররফ শাহ। সর্বশেষ দুই পক্ষের সংঘর্ষে জড়ানো রামদা হাতে থাকা হেলমেটধারী ও মুখে গামছা জড়ানো ছাত্রলীগ নেতাদের ছবিও প্রকাশ করা হয় প্রথম আলোতে।
পরদিনই মোশাররফের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজে উপাচার্য ভবনে যাওয়ার সময় ১০-১৫ জন মিলে একটি অনুষদের সামনে তাঁকে মারধর করে। মারতে মারতে একটি হল পর্যন্ত নিয়ে যায়, সেখানে আরেক দফা মারধর করা হয়। এ সময় তাঁকে পরে আর ছাত্রলীগ নিয়ে প্রতিবেদন না করার হুমকি দেওয়া হয় এই বলে—‘আর নিউজ করিস, তারপর দেখব তোরে কে বাঁচাতে আসে। ছাত্রলীগকে নিয়ে কোনো নিউজ হবে না।’
হামলাকারীরা তাঁর কপাল ও মুখে কিলঘুষি দেন। তাঁর বুকে লাথি দেন। হাতেও আঘাত করেন। এতে তাঁর কপালে চারটি সেলাই দিতে হয়েছে এবং কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার কারণে কিছুটা কম শুনতে পাচ্ছেন তিনি।
এর আগেও ক্যাম্পাসে সংবাদকর্মীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। গত ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক সমকাল-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মারজান আক্তারকে হেনস্তা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মুঠোফোনে ভিডিও করার কারণে নেতা-কর্মীরা মারজানকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। কিন্তু এখনো কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েক দিন আগে সংঘর্ষে জড়ানো রামদা হাতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের পরিচয় শনাক্ত হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
উপাচার্যের বাসভবন ও পরিবহন দপ্তরের ৬০টির বেশি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা গেছে বলেও জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় বিপুল সম্পত্তি নষ্টকারীদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি, একাডেমিকভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন সম্প্রতি ‘দুর্নীতি-উৎসাহী’ বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। তবে ১৫ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আতঙ্ক তৈরি করে রাখা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইলিয়াস মিয়াকে তিনি বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর জন্য তিনি ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত দেনদরবার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মতো সদিচ্ছার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারকে।
ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এত দিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বাতিল করেনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এতে আরও বেশি প্রশ্রয় পেয়েছেন রুবেল-টিপুসহ অন্য আদু ভাইয়েরা। দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সেই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এখন এই সব অছাত্র আদু ভাইদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘সাহস’ করবেন কি উপাচার্য। কথা হচ্ছে, দেশের অন্যতম শীর্ষ এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এই পরিস্থিতিতে নিয়ে আসার জন্য তাঁর কি লজ্জা হওয়া উচিত নয়?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com