গত মঙ্গলবার যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সূচনা হয়েছে, তার বর্ণনায় দুটি দৈনিকের শিরোনাম বেশ চোখে পড়ে। দেশের অন্যতম পুরোনো দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছে, ‘অন্য রকম এক সংসদের যাত্রা শুরু’। আর বাংলা ট্যাবলয়েড মানবজমিন শিরোনাম করেছে, ‘আজব কিসিমের পার্লামেন্ট’। এ দুটি শিরোনামে নির্বাচনের পরও যে দেশের রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত আছে এবং শিগগির তা থেকে পরিত্রাণের সম্ভাবনা নেই, তা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। খবরের ভেতরে শিরোনামের ব্যাখ্যাও মেলে। ২৯৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে এক হিসাবে ২৮০, অন্য হিসাবে ২৮২ জন আওয়ামী লীগের নেতা। বিরোধী দল নামের যাঁরা আছেন, তাঁরাও আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়া আসনের প্রতিনিধি। ফলে যে নামেই ডাকা হোক, এটি একটি একদলীয় সংসদ।
অরাজনৈতিক নাগরিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) ভাষায় যা ছিল অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, একই দলের ‘স্বতন্ত্র’ ও অন্য দলের সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের ‘পাতানো খেলা’। এটিকে তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে বর্ণনা করেছে। নির্বাচন বর্জনকারীদের সমালোচনার উল্লেখ নাহয় না-ই করলাম। তবে এ রকম একটি পাতানো নির্বাচন পরিচালনার দায় যাদের, সেই নির্বাচন কমিশনের প্রধান, কাজী হাবিবুল আউয়ালও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। গত ১৮ জানুয়ারি আমরা তাঁর মুখেই শুনলাম, ‘নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি’ এবং ‘নির্বাচনব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা অনেকটা কমে গেছে’।
এই উপলব্ধির জন্য দেশের রাজনৈতিক ক্ষতি যা হয়েছে, তা আগামী দিনগুলোয় যে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকবে, সে কথা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু এর আর্থিক ব্যয়ও উপেক্ষণীয় নয়। টিআইবির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হিসাব বলছে, নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য মোট বাজেট ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা হলেও তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ব্যয় ছিল ৭০০ কোটি, ২০১৪ সালে ৩০০ কোটি এবং ২০০৮ সালে ২০০ কোটি। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে নির্বাচনের খরচ ১০ গুণের বেশি বাড়লেও নির্বাচনের মান উন্নত না হয়ে বহুগুণে নিম্নমুখী হয়েছে।
খরচ বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে টিআইবি আরও চমকপ্রদ তথ্য উদ্ধার করেছে। তারা বলছে, আগের নির্বাচনে, ভোটের সময়ে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের এক দিনের ভাতা দেওয়া হলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের দুই দিনের সম্মানী, ম্যাজিস্ট্রেট ও সমমানের পদের কর্মকর্তাদের পাঁচ দিনের সম্মানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ১৩ দিনের সম্মানী দেওয়া হয়। মোট নির্বাচনী বাজেটের ৫৪ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যয়ের কোনো ব্যাখ্যা টিআইবি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পায়নি।
যে নির্বাচনব্যবস্থায় জনগণের আস্থা কমে গেছে, ক্ষমতাসীন জোটের পরাজিত নেতারা যাকে প্রহসন অভিহিত করেছেন, ভোটের অবিশ্বাস্য হার নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের কোনো ব্যাখ্যা দিতে কমিশন যেখানে অক্ষম, সেখানে একই কমিশন কীভাবে আরও নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে, সে প্রশ্ন তোলা জরুরি।
২০১৪ সালে কাজী রকিব কমিশনের অধীন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের পর এ প্রশ্ন উঠলেও তা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। কারণ, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট নিয়েই তখন রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রবল ও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৮ সালে কে এম নূরুল হুদা কমিশনের অধীন রাতের ভোটের পর নির্বাচনব্যবস্থায় আস্থা ফেরানোর বিষয়টি কিছুটা গতি পায়। ক্ষমতাসীন দল একতরফাভাবে নির্বাচন কমিশন আইন করে বোঝাতে চাইল যে সমস্যার সমাধান পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন ওই আইনের অসারতা প্রমাণিত হওয়ার পর সিইসি আউয়াল বলছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও প্রয়োজন হবে একটি পদ্ধতি অন্বেষণ করা।’
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার পদ্ধতি অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ-আলোচনা ছাড়াই এখন শুরু হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি। কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এবং সারা দেশের পাঁচ শতাধিক উপজেলার নির্বাচনের জন্য কমিশন তোড়জোড় শুরু করেছে। এ নির্বাচনের খরচও যে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম কিছু হবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু নির্বাচনে কী হতে পারে? ক্ষমতাসীন দলের পছন্দই যখন সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি, তখন এসব ভোটের আয়োজনে জনগণের মতামতের আদৌ কোনো প্রতিফলন ঘটে না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার খবর বেরিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। কেউ কেউ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগতও জানিয়েছেন। তাঁদের অতি সরল ভাবনা হচ্ছে, দলীয় মনোনয়নের বিধান না থাকলে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অতটা বেপরোয়া হবে না। বাস্তবতা কি এ ধারণা সমর্থন করে? হাতে গোনা চার-পাঁচটি ব্যতিক্রম ছাড়া গত ১০ বছরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের শত শত নির্বাচনের রেকর্ড যাচাই করলে দেখা যাবে, ক্ষমতাসীন দল নানা কৌশলে দলীয় প্রার্থীদেরই কাঙ্ক্ষিত আসনে বসাতে পেরেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক দিন ধরেই সারা দেশে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেছে। এমনকি পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোতেও নির্বাচনপ্রক্রিয়া কলুষিত হওয়ার অসংখ্য নজির সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত আইনে ২০০৯ সালের পর যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার লক্ষ্য ছিল এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের বিধান তৈরির উদ্দেশ্যও তা-ই ছিল। এখন নির্দলীয়তে ফিরে যাওয়ার কারণও তা-ই, এটি কোনো রাজনৈতিক উদারতার বিষয় নয়।
সংসদীয় নির্বাচনে দলীয় গঠনতন্ত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে দলের নেতা–কর্মীদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়ার কারণ ছিল সংসদে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তাতে রক্তারক্তিটা একটু বেশিই হয়েছে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর দুই দলের সংঘর্ষে যতজনের (১৫ জন) মৃত্যু হয়েছে, এবার ‘আমি’ আর ‘ডামি’র সমর্থকদের হানাহানিতে দলীয় কর্মীর প্রাণহানির সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়। অন্তর্দলীয় লড়াই এখনো চলছে। সুতরাং নৌকা প্রতীক নিয়ে মারামারি বন্ধের বিষয়টি এখন অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়ানোয় আবারও আইন সংশোধনের উদ্যোগ।
এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা দলের ডামি প্রার্থীর কাছে হেরেছেন, তাঁরা মূলত দলের কৌশলগত প্রয়োজনে কোরবানি হয়েছেন, ইংরেজিতে তাঁদের স্যাক্রিফিশিয়াল ল্যাম্ব বলা হয়। কিন্তু এবারের এসব স্যাক্রিফিশিয়াল ল্যাম্ব ছাড়া গত ১৫ বছরে সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নই ছিল শেষ কথা। নির্বাচনব্যবস্থায় সৃষ্ট সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান ছাড়া শুধু নির্বাচনকে নির্দলীয় ঘোষণায় এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
দলীয়ভাবে নির্বাচন না হলে বিএনপির দলীয়ভাবে এতে অংশগ্রহণ করা না–করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। ফলে তাদের মাঠপর্যায়ের সমর্থকদের কেউ কেউ প্রার্থী হলেও হতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকার পরিচালনায় বিরোধী দলের সদস্যপদ যে কী ধরনের বাধা বা বিড়ম্বনার কারণ হয়, তা সাবেক মেয়রদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে। বিষয়টি রাজনৈতিক সংস্কৃতির এবং গণতন্ত্রের। জাতীয় পরিসরে গণতন্ত্র কার্যকর না থাকলে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রকে কার্যকর করার স্বপ্ন একেবারেই বাতুলতা।
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক