কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না
কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না

কোটার ওভারকোট খুলে ভেতরের দাবি দেখতে হবে

অনেক নাবিক সাগরে ভাসমান বরফের পাহাড়ের চূড়াকে দূর থেকে সামান্য একখণ্ড বরফ ভেবে ভুল করেন। সেটি যে পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় থাকা বরফের বিশাল পাহাড়ের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশমাত্র (যেটিকে বলা হয় ‘টিপ অব আইসবার্গ), তা নাবিকেরা অনেক সময় বুঝতে পারেন না। আর সেটি সময়মতো বুঝতে না পারলে নিমজ্জিত থাকা বরফের পাহাড়ে জাহাজের সংঘর্ষ লাগে এবং নাবিকদের মহাবিপদে পড়তে হয়। 

চলমান পরিস্থিতিকে নাবিকের টিপ অব আইসবার্গ চিনতে না পেরে বিপদে পড়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেকোনো প্রতিবাদ বা বিক্ষোভের শুরু হতে পারে সামান্য এক ঘটনা থেকে। উদীয়মান মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষার আপাত বিচারে মনে হওয়া নিতান্ত মামুলি দাবি অনেক সময় আমজনতার দাবিতে পরিণত হতে পারে। 

মনে পড়ছে তিউনিসিয়ার ঘটনা। রোজকার মতো সেদিনও রাজধানী তিউনিসে রুটির দোকানে একটি রুটি কিনতে এসেছিলেন দিন আনা দিন খাওয়া এক মানুষ। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দাম তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। দোকানির সঙ্গে এ নিয়ে শুরু হয় বচসা, তারপর চেঁচামেচি, হইচই। মেজাজ হারিয়ে দুই ঘা বসিয়ে দেন দোকানি। 

রুটি কিনতে আসা অভুক্ত সেই গরিব ক্রেতা মাটিতে পড়ে যান। আর উঠতে পারেননি। সেখানেই জান হারান তিনি। এ রকম পরিণতির জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। উপস্থিত পথচারী, মজা দেখতে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভিড়—সবাই নিজেদের মধ্যে সেই অতিরিক্ত দাম দিতে অক্ষম গরিব ক্রেতাকে খুঁজে পান। তাঁরা মনে করতে থাকেন, রাস্তায় লুটিয়ে পড়া ক্রেতার লাশটা যেন তাঁদেরই লাশ। 

জনতার কাছে বাড়তি দাম চাওয়া রুটির দোকানটা জনতার কাছে হয়ে ওঠে স্বৈরাচার সরকারের প্রতিভূ। দোকানদার পালিয়ে বাঁচলেও জনতার দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় রুটির দোকান। রুটি কিনতে আসা লোকটির লাশ নিয়ে বের হওয়া মিছিলে নারী-পুরুষের ঢল নামে। জানাজায় শরিক হয় লাখ লাখ মানুষ। জানাজা হয়, দাফন হয়, কিন্তু ক্ষোভের আর দাফন হয় না, বরং তা বাড়তে থাকে। সহিংস থেকে সহিংসতর হতে থাকে সেই জনরোষ। 

ক্ষমতাসীনেরা ভাবলেন, রুটির দাম নিয়েই যখন সূত্রপাত, তখন রুটির দাম কমিয়ে দাও। কিন্তু দেখা গেল, রুটির দাম কমিয়ে মানুষের ক্ষোভের আগুন নেভানো গেল না। বরং তা আরও জ্বলে উঠল। জনবিচ্ছিন্ন শাসকেরা রুটিটাই দেখেছিল; আর মানুষ রুটির মধ্যে দেখেছিল ঝলসানো দেশ। তারা দেখেছিল, দুর্নীতি আর দেশের অর্থসম্পদ পাচারের সুবিধাভোগী ও মদদদাতাদের হাতে দেশ নামের রুটিটি ঝলসে গেছে। 

রুটিওয়ালার ফাঁসি বা সব রুটির দোকানির লাইসেন্স বাতিল ক্ষিপ্ত মিছিলের প্রাথমিক দাবি থাকলেও তা আর সেখানে আটকে থাকেনি। বিরতিহীন সেই আন্দোলনের স্রোতোধারা দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।  

ছাত্রদের সর্বশেষ কোটা আন্দোলন যে শুধু চাকরির জন্য, সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কোটা আন্দোলনের আড়ালে অনেক বঞ্চনার চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা থাকার জায়গা পান না, মানসম্মত খাবার পান না, লাইব্রেরিতে বই পান না, বসে পড়ার জন্য একটা টুল পান না। না খেয়ে সাতসকালে লাইন দিতে হয় লাইব্রেরিতে ঢোকার জন্য। পদে পদে বঞ্চনা আর বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাঁদের। 

এসব মেনে নিয়েও তাঁরা এগোতে চান। আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু যে সোনার হরিণ নিয়ে তাঁদের আশা, সেটি যখন কোটার নামে আরও দূরের বস্তুতে পরিণত করা হয়, তখন তাঁরা আর বসে থাকতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছেই এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের চার শিক্ষার্থী একবার আমাদের সহযাত্রী ছিলেন। একসঙ্গে যাচ্ছিলাম পাবনার চাটমোহরে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রতিষ্ঠিত উচ্চমানের একটি কমিউনিটি স্কুল দেখতে। 

হাসিখুশি চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল এত নিপীড়ন–নির্যাতন সহ্য করে কীভাবে এই অল্প বয়সী মানুষগুলো টিকে থাকেন, হাসেন, কথা বলেন। নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁরা উপেক্ষিত, বঞ্চিত, যেন তাঁরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। 

চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সঠিকভাবেই তাঁর ফেসবুক দেয়ালে লিখেছিলেন, ‘আপনারা যাঁরা ভাবছেন আন্দোলনটা স্রেফ একটা চাকরির জন্য, তাঁরা বোকার স্বর্গে আছেন। আপনারা এর সব কটি স্লোগান খেয়াল করেন। দেখবেন, এই আন্দোলন নাগরিকের সমমর্যাদার জন্য। এই আন্দোলন নিজের দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে না বাঁচার জন্য। এই আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, দেশের মালিক তাঁরা নন, আসল মালিক জনগণ। সেই জনগণকে রাষ্ট্র যে পাত্তা দেয় না, এই আন্দোলন সেটার বিরুদ্ধেও একটা বার্তা। রাষ্ট্র জনগণকে কেন পাত্তা দেয় না, এই আন্দোলনকারীরা সেটাও বোঝে। যে কারণে ভোটের বিষয়টাও স্লোগান আকারে শুনেছি। আমি এটাকে এইভাবেই পাঠ করছি।’ 

আমাদের সেই সহযাত্রীরা জানিয়েছিলেন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পৌঁছানোর পরও ন্যায্য পথে হলে থাকার জায়গা পাননি। হল কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দেওয়ার পরও তাঁদের একজনকে হলে উঠতে দেওয়া হয়নি। পার্টির বসকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা এককালীন ‘পাওনা’ না দিলে তিনি জীবনেও উঠতে পারবেন না তাঁর নামে বরাদ্দ করা কক্ষে। 

এ কথা কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। তাহলে তাঁরা, বিশেষ করে মেয়েশিক্ষার্থীরা থাকেন কোথায়? তাঁরা হলে সিট না পেয়ে আশপাশের সরকারি কোয়ার্টারে একটা ঘর ভাড়া করে কয়েকজন মিলে থাকেন। সেখানেও অনেক ‘প্যারা’। কারণ সব বাড়িওয়ালা ব্যাটার ‘নজর’ ভালো নয়। এরপরও তাঁদের থাকতে হয় ঢাকায়। ভাগ্যগুণে এককালীন টাকা দিয়ে হলে একটা হিল্লে হলেও তঁাদের ‘মাসিক’ (মাসভিত্তিক চাঁদা) দিতে হয় নেত্রীকে। তা ছাড়া উত্সবভিত্তিক চাঁদাও আছে। 

প্রখ্যাত লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ভাষায় ‘গণরুম নামক জেলখানা’ সেখানেও আছে। অতি সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের বয়সী আমার এক নাতি পড়ে ঢাকার বাইরে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বছরেও সে হলে একটা বরাদ্দ পায়নি। থাকে মেসবাড়িতে। প্রভোস্টের কাছে গিয়ে বহুবার আবেদন–নিবেদন করেছে। তাঁর একই কথা, ‘নেতাদের ধরো। তাঁরা চাইলেই হবে।’ সে নেতাদের কাছেও ধরনা দিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ‘আপনার জন্য তো সিস্টেম ভাঙা যাবে না। সিনিয়র হয়েছেন তো কী হয়েছে? আগে গণরুমে ওঠেন। মিটিং–মিছিলে শামিল হন, তারপর দেখা যাবে।’ 

এসব অনিয়ম আর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বিলোপের কথা গত কোটা (২০১৮) আন্দোলনের সময়ও ছিল। সেই সময় একঝটকায় সব কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তে আন্দোলনের নেতারা এমনই মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন যে শিক্ষাজীবনের চলমান বঞ্চনা ও বৈষম্যের ফোকরগুলো নিয়ে তাঁরা আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। সেবারের কোটা আন্দোলনের নেতারা বড় নেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন। তাঁরা ক্রমে অন্য বন্দরের ঠিকানা খুঁজতে থাকেন। 

এবার ছাত্রদের সর্বশেষ আট দফা দাবির মূলেও আছে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা একাডেমিক জীবনের বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করার কথা। যেমন (ক) হলে হলে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দের ব্যবস্থা, (খ) ছাত্র সংসদ চালু করা, (গ) একাডেমিক হয়রানি বন্ধ করা। 

কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি শতভাগ পূরণ হলেও চলমান শিক্ষাজীবনের বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর হবে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ থেকেই যাবে। এমন খণ্ড খণ্ড অসন্তোষ আবার কোনো দিন অন্য কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে জ্বলে উঠতে পারে। 

এ কারণেই ছাত্রদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে কারফিউর মধ্যেও আদালত বসিয়ে কোটা সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেই একই রকম গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটগুলো ছাত্রদের অন্য দাবিগুলো সত্বর পূরণের ব্যবস্থা করুন। তাহলেই ছাত্র–অসন্তোষ ক্রমে প্রশমিত হতে পারে। অন্যথায় নয়। 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক 

nayeem5508@gmail.com