পাহাড়ের ‘লোগাঙ’ কবে শুকাবে

১১ ডিসেম্বর সোমবার খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ইউপিডিএফ সমর্থিত চার নেতা–কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে তাঁদের মরদেহের কফিন
ছবি: প্রথম আলো

‘লোগাঙ’ খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার একটি জায়গার নাম। যার অর্থ হলো রক্তের গাঙ। লোগাঙ নামটির সঙ্গে জায়গাটির মধ্যে কোথায় যেন একটা করুণ নিয়তির গভীর মিল আছে! বিভিন্ন সময় পানছড়ির লোগাঙ বারবার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।

১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল লোগাঙ গুচ্ছগ্রামে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে অভিযোগ করেছিলেন, বাঙালি সেটেলারদের আক্রমণে সেদিন শতাধিক পাহাড়ি নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন।

এ ঘটনার পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৎকালীন সরকার বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস পর এ কমিশন ইংরেজিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, সেই রিপোর্ট অনুযায়ী লোগাঙ গণহত্যায় মারা গেছেন মাত্র ১২ জন!

নিহতের সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি দ্বারা প্রাপ্ত নিহতের সংখ্যা ও স্বীকারোক্তি এটাই প্রমাণ করে যে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা সেদিন লোগাঙে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।

১১ ডিসেম্বর সোমবার খাগড়াছড়ির পানছড়িতে ইউপিডিএফ সমর্থিত চার নেতা–কর্মী বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরাকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। অন্য তিন কর্মীকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে।

ঘটনার পর স্থানীয় লোকজনের বারবার ফোনের পরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ উদ্ধারে পুলিশের দীর্ঘসূত্রতা ও গড়িমসি ভাব সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

‘দুর্গম এলাকার’ দোহাই দিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের এই আচরণ কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের অবস্থান দুর্বৃত্তদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আরও উৎসাহিত করবে।

পাহাড়ে, বিশেষত খাগড়াছড়িতে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। কিন্তু কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না বলে অনেকে মনে করেন।

২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে অস্ত্র উঁচিয়ে চলে যায়। অথচ সেই বাজার থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরেই বিজিবি জেলা সদর দপ্তরের অবস্থান।

অন্যদিকে ২০১৭ সালের ৭ জুন একই স্থানে (স্বনির্ভর বাজার) কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের আহূত সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

পুলিশ স্থানীয় এলাকায় ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই সংগঠকসহ কমপক্ষে ২১ জন নারীকে আটক করেছিল (সূত্র: প্রথম আলো, ৮ জুন ২০১৭)।

উল্লিখিত দুটি ঘটনায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বিমুখী আচরণ তাদের অবস্থান পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থানের বিষয়টিকেই তুলে ধরে।

পাহাড়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড, অপহরণ আর গুমের মিছিল কবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। ২০০১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পানছড়ির লোগাঙে রূপক চাকমার প্রাণ ঝরেছিল। এবার ঝরে গেল বিপুল চাকমাসহ চার তরতাজা তরুণের প্রাণ। রূপক চাকমা আর বিপুল চাকমা দুজনই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাবেক সভাপতি ছিলেন।

২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি আরেক সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমার মরদেহ পাওয়া যায় খাগড়াছড়ি সদরের রাস্তায়। পাহাড়ের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়া এ মুখগুলোকে কেন এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হচ্ছে?

বিপুল চাকমা, রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা, সুনীল ত্রিপুরা ও লিটন চাকমা (বাম থেকে)

পাহাড়ে সংঘটিত এসব ঘটনাকে সব সময় সরলীকরণ করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়।

কিন্তু একটা বিষয় আমাদের বোধগম্য হয় না, প্রতিদিন বিভিন্ন মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব বা বিরোধের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে প্রাণহানি বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোকে কি কখনো বাঙালিদের মধ্যে ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়?

পাহাড়ের ক্ষেত্রে কেন ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও অভ্যন্তরীণ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করে ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে? কেন দায়টা পাহাড়িদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়?

দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাহাড়ের এ বিভাজিত রাজনীতির পেছনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে, এ মরণখেলার নাটাই কারা নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই প্রশ্ন কেউ তোলেন না।

পাহাড়ে সংঘটিত ঘটনাকে সব সময় সরলীকরণ করে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। পাহাড়ের ক্ষেত্রে কেন ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও অভ্যন্তরীণ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করে ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে? কেন দায়টা পাহাড়িদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়?

দুই.

এ বছরের বিজয়ের মাসটি পাহাড়িদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে বিজয়ের মাস, ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরের অভিযাত্রা, সেই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল।

২৬ বছরে চুক্তির পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব কষতে গিয়ে দেখা যায়, এ দীর্ঘ সময়ে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে একরাশ হতাশা বিরাজ করছে।

সরকার যতই বলুক চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে কিন্তু সেই বাস্তবায়ন যে পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি আনতে পারেনি, সেটা সাম্প্রতিক ও বিগত সময়ের ঘটনাবলি থেকেই স্পষ্ট।

ফলে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতির প্রতি পাহাড়ের মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট রয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, সময় যতই গড়াচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি থেকে সরকার ততটা দূরে সরে যাচ্ছে। তাই বিজয়ের অনুভূতি নয়, মিশ্র আবেগ আর হতাশা দিয়েই বিজয়ের মাসটি বয়ে যাচ্ছে।

‘দিনবদলের সনদ’-এর অঙ্গীকার নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট যে ভূমিধস বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, আজ ১৫ বছর পরে সেই দিনবদলের সনদ পাহাড়ে কতটুকু পরিবর্তন এনেছে, সেটা মূল্যায়ন করার সময় এসেছে।

গত ১৫ বছরে চিম্বুক পাহাড় থেকে মধুপুরের শালবন, সিলেটের খাসিয়াপুঞ্জি থেকে বান্দরবানের লামা পাহাড়ের ম্রোদের আর্তনাদ আর কান্নার কী জবাব আছে সরকারের কাছে?

এ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখনো খুঁজে ফিরছে।

আমরা বলতে চাই, বিপুল চাকমাসহ পাহাড়ে অকালে ঝরিয়ে দেওয়া তরুণের ‘লোগাঙ’ অচিরেই বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ের মানুষের মধ্যে পুঁতে দেওয়া বিভাজন নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

● ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক