১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব একপর্যায়ে জোসেফ স্তালিনের দখলে চলে যাওয়ায় যাঁরা ছিটকে পড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কিও ছিলেন।
সেই বাস্তবতা নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছিলেন। বইয়ের শিরোনাম ‘রেভল্যুশন বিট্রেইড’। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘বেহাত বিপ্লব’।
নাহ্! জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর বাংলাদেশ বিপ্লব নিয়ে সে রকম আক্ষেপ যেন আমাদের না করতে হয়।
দেশের রাজনৈতিক পরিসর ইতিমধ্যেই সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনুমাননির্ভর বিতর্কের গোলকধাঁধায় পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে—জাতীয় নির্বাচন কবে দেওয়া হবে? এর আগে রাষ্ট্রীয় সংস্কার কর্মসূচি কি পূর্ণতা পাবে? পেলে কবে নাগাদ পাবে?
দোস্ত-বুজুর্গ, নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা যে চালু করতেই হবে, তা নিয়ে তর্ক করার সুযোগ নেই। সরকার পরিচালনায় কৈফিয়তের সংস্কৃতিও চালু করতে হবে—সে গরজও থাকতে হবে।
রাষ্ট্র মেরামত ও জনহিতকর ব্যবস্থার দাবিসমেত আরও কিছু মহান উদ্দেশ্যেই ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটানো হয়; দায়িত্ব নেয় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসন।
রাষ্ট্র পরিচালনার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ‘টিম ইউনূস’ তাদের কাঁধে আসা ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পন্ন করতে ইচ্ছুক।
আর নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নতুন বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রস্তুতির কথাই জানান দিচ্ছে।
দুই পক্ষের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি আছে; কিন্তু ধরে নিচ্ছি কারোরই আখেরি চাওয়া অযৌক্তিক নয়। কারণ, উভয় অর্জনই হবে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবিরত সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ।
একসময় যে বক্তারা প্রচার করতেন, শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই, তাঁরা এখন দেখুন, তাঁদের নেত্রীর বিদায়ে কত তরুণ ও প্রৌঢ় নেতার উত্থান হয়েছে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া নেতৃত্ব তৈরির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
চলমান বাস্তবতায় সেই ফ্যাসিবাদী দলদাসেরা অবশ্য দেখতে চান তাঁদের প্রভুরই এক নিকৃষ্ট মানের বিকল্প শাসন, যাতে তাঁদের অশোভন ও অপরাধপ্রবণ রাজনৈতিক আচরণের ‘মান’ রক্ষা হয়।
তরুণদের উদ্যোগে নতুন দল গঠনের খবর আসছে; যদিও নিকট ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিধারা, দলীয় বিন্যাস ও জোট গঠন এবং বিপ্লব-পরবর্তী দিকনির্দেশনা ও ভিশন নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
নির্বাচন, ক্ষমতা, দল গঠন বা নিষিদ্ধকরণ নিয়ে দড়ি–টানাটানির এ অবস্থা কি জীবন–জীবিকার সংগ্রামে থাকা মানুষের খুব দুশ্চিন্তার বিষয়, যদি না তাদের কল্যাণে সেই রাজনীতি হয়?
সম্ভাব্য নতুন দলের আগমনে নতুন প্রতিযোগিতায় গণমুখী দলগুলোর অসুবিধা না থাকলেও আওয়ামী লীগ কেন স্বাগত জানাবে নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে, যে শক্তি নিজেদের রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন!
হাসিনার আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনী ট্রেনে উঠতে ইনিয়ে-বিনিয়ে এমন প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, যেন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের চেয়ে উচ্চমার্গের গণতন্ত্রপ্রেমিক তারা।
ভলতেয়ার একবার বলেছিলেন, ‘আপনি যা বলতে চান, তার সঙ্গে আমি একমত নই, স্যার। তবে আমি আপনার বলার অধিকার আমৃত্যু রক্ষা করব।’
এর উল্টোটিই তো ছিল খাঁটি আওয়ামী সংস্কৃতি; নাকি ভুল বললাম? আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো আক্রমণকারী ছাত্রলীগমুক্ত ঘোষণা করা হলে ঘনিষ্ঠ ‘সূত্রে’ জেনেছি, সংগঠনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘একটা একটা করে দেখে নেওয়ার’ পণ করেছিলেন।
সম্প্রতি দিল্লি থেকে হাসিনার এবং গোপন আস্তানায় থাকা অন্য আওয়ামী নেতা-কর্মীদের তৎপরতা, বিশেষ করে হুমকিতে হাসিনাবিরোধী গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র–সমন্বয়কারীরা সন্ত্রস্ত বলে জানা গেছে।
ছাত্র-সমন্বয়কারীদের আশঙ্কা, আওয়ামী গোষ্ঠীর ন্যূনতম রাজনৈতিক পুনর্বাসন হলে সবার আগে ফ্যাসিবাদী আক্রমণের শিকার হবেন এই তরুণেরা।
হাজারো মানুষ খুন ও সীমাহীন অপকর্ম এবং বারবার গণতন্ত্র হত্যার পরও আওয়ামী লীগ দলটি নিয়ে সমাজ ও রাজনীতিতে সুস্পষ্ট নৈতিক অবস্থান না থাকাটা নতুন প্রজন্মের সামনে হবে অতি বাজে এক দৃষ্টান্ত। এটি হবে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে মশকরা।
অন্যায়কারীর সঙ্গে বিনা বিচারে আপস করা যদি হয় ‘রিয়েল পলিটিক’ বা বাস্তববাদী রাজনীতি, তাহলে রাজনীতির মানে দাঁড়াবে নৈতিকতা–বিবর্জিত কর্ম।
হাসিনার আদলে ক্ষমতায় থাকতে বা আসতে বহিঃশক্তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নাম যদি হয় ‘ডিপ্লোমেসি’ বা কূটনীতি, তখন আর জাতীয় স্বার্থ বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
এ–জাতীয় ‘বাস্তববাদী’ অনেক মানুষ, ‘গুণীজন’ ও ‘প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর’ও একত্রে উচিত কথা বলেননি এবং উচিত কাজ করেননি বলেই আওয়ামী দুঃশাসন গণতন্ত্রকে বন্দী করে দেশবাসীকে দেড় দশকের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জেল-জুলুম দিয়ে অপদস্থ করেছিল।
আহ্! সেই হাসিনার বিরহে মুহূর্তেই রাজনীতিকেরা ভুলে যাবেন তাঁর তিন তিনটি জোচ্চুরির নির্বাচন, অসংখ্য মানুষকে খুন ও গুম করা এবং জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন, পাচারসহ দেশবাসীর বিরুদ্ধে অমার্জনীয় যত অপরাধ!
ক্ষমতাবলয়ের ভেতর ও বাইরের নেতৃত্বের ভুলে যদি ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ আবারও রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রাস করে, তাহলে মুক্তি পেতে আবারও কি কয়েক প্রজন্মের রক্ত ঝরবে না?
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও তাঁর গণবিরোধী শাসনের সহযোগী জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ১৪ দল এবং সফট পাওয়ারের ‘গুটিরা’ বুঝেশুনেই গণতন্ত্র হত্যার রাজনীতি করেছে।
এর বিরুদ্ধে বিএনপিসহ অন্যান্য দল ও কিছু বিবেকতাড়িত ‘সরল’ মানুষ আন্দোলন চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর; যদিও চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি যতক্ষণ না নতুন প্রজন্ম ও গণমানুষ সর্বাত্মক প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
নতুন শতাব্দীর বিপ্লবে আমাদের শিক্ষা এই যে আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকার বাসনায় মশগুল হাসিনার পিতার সম্পত্তি ছিল না আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আন্দোলন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি প্রজন্ম বা গোষ্ঠীর হাতেই বন্দী থাকবে—তা–ও ভাবতে পারছি না।
আজকের ছাত্রদের নেতৃত্বও শেষ কথা নয়, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারও তা হবে না। টেকসই গণতন্ত্র শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনকে ধারণ করে।
অবশই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব এবং জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ ও কারবার করতে পারার সুবিধা একটু বেশি। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ইস্যুতে সন্তানতুল্য ছাত্রদের সঙ্গে বিরোধ বা বিতর্কে জড়িয়ে পড়া স্মার্ট রাজনীতিকদের জন্য বেমানান।
দুর্নীতি কি থেকেই যাবে? চাঁদাবাজি? বাজারে স্বস্তি আসবে? কমবে বৈষম্য? বাড়বে চাকরি, ব্যবসার সুযোগ? সুচিকিৎসা বা সুশিক্ষার কী হবে? ন্যায়বিচার পেতে খরচ লাগবে কত? মিডিয়ায় সত্য শোনা যাবে? গণমুখী হবে ক্ষমতাসীনেরা? এ দেশের ‘পোড় খাওয়া’ মানুষ এ–জাতীয় অনেক প্রশ্নের উত্তর আশা করে, শুধু ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারের কাছ থেকে নয়; বরং আগ্রহী নেতৃত্ব গণজিজ্ঞাসার সদুত্তর দিতে প্রস্তুতি নিতে পারেন।
আবার পুরোনোরা ব্যর্থ হলে নতুন প্রজন্ম ভিন্ন রাজনীতি ও নেতৃত্ব নিয়ে সামনে আসবে; তাতে অন্তত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অসহিষ্ণু হওয়ার অধিকার কারও নেই।
যতক্ষণ ইউনূস সরকার সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, ক্ষমতার সম্ভাব্য দাবিদার দল বা দলগুলো নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে, পাবলিক স্পেসে রাজনৈতিক আলোচনার দখল নিতে পারে।
যেমন দুর্নীতি কি থেকেই যাবে? চাঁদাবাজি? বাজারে স্বস্তি আসবে? কমবে বৈষম্য? বাড়বে চাকরি, ব্যবসার সুযোগ? সুচিকিৎসা বা সুশিক্ষার কী হবে? ন্যায়বিচার পেতে খরচ লাগবে কত? মিডিয়ায় সত্য শোনা যাবে? গণমুখী হবে ক্ষমতাসীনেরা?
এ দেশের ‘পোড় খাওয়া’ মানুষ এ–জাতীয় অনেক প্রশ্নের উত্তর আশা করে, শুধু ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারের কাছ থেকে নয়; বরং আগ্রহী নেতৃত্ব গণজিজ্ঞাসার সদুত্তর দিতে প্রস্তুতি নিতে পারেন।
কোন কায়দায় হাসিনা ও তাঁর দলবলের অপরাধ মার্জনা করা যায়, সেটাকে রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার প্রকল্প বানানোর সময় এটা নয়। পতিতরাই–বা কি জনগণকে বলেছেন, তাঁদের ‘ক্ষমা করো’, ‘ভালোবাসো’?
হাসিনা ও আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের যেকোনো উদ্যোগে যেকোনো দলের প্রকাশ্য বা গোপন সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা ওই দলের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দেবে। আবার শুধু আওয়ামী লীগের সমালোচনাও তাকে উদ্ধার করবে না; যেমন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ছাড়া রেহাই পাবে না ইউনূস সরকারও।
ভাবী ক্ষমতাসীন দলকে জনগণ মূল্যায়ন করবে তাদের নৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থান এবং জনকল্যাণের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাজ করার সামর্থ্য দিয়ে।
অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও জনপ্রিয় দল কখনো কখনো তাদের জনসমর্থন মাপতে ভুল করে বসে। কারণ, দলগুলো তাদের ভোটব্যাংককে স্থির বিবেচনা করে এবং তার অন্যতম কারণ নতুন প্রজন্মের আগমন সেভাবে আমলে নিতে পারে না।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেও হয়তো বড় দলগুলোর সুস্পষ্ট ধারণা নেই, ৪০ বছরের নিচে বয়সী যে এক বিশাল প্রজন্ম, যারা এখনো ‘হাসিনার কল্যাণে’ ভোট দেওয়ারই সুযোগ পায়নি, তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য আসলে কোথায়।
না খেয়ে, না ছুঁয়েও তাদের (এবং অন্য সবার) মাথায় এখন হাসিনার দায়—শত বিলিয়ন ডলার জাতীয় ঋণ। তারা সিভিল সার্ভিসে কোটাকে বৈষম্য হিসেবে দেখেছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তারাই বিশ্বাস করেছে, দানবীয় হাসিনা শাসনের ইতি টানা সম্ভব। ৫ আগস্ট তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পলায়ন করেন তাদের ধাওয়ায়।
এই তরুণদের প্রত্যাশা পূরণের গুরুদায়িত্ব এখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের। অন্যথায় নতুন প্রজন্মই বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং বাধ্য হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে জ্যেষ্ঠদের দিকে।
ক্ষতি কী, যদি সন্তানেরা পিতাদের ছাড়িয়ে যায়!
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক।