গত মাসের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি অনেকটাই গতি পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কূটনৈতিকভাবে দামেস্কে একধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার পর সম্প্রতি প্রথম ওমান সফরে যান। এ সপ্তাহে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড় একটা উল্লম্ফন হয়েছে। ভূমিকম্প-পরবর্তী কূটনীতির অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দামেস্ক সফর করেছেন। দীর্ঘ এত বছরে দুই দেশের সম্পর্কের সেতুর নিচ দিয়ে অনেক পানিই গড়িয়েছে। আরও সরল করে বললে, অনেক বেশি রাজনীতিও হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্ক ও সিরিয়ায় যে প্রলয়ংকর ভূমিকম্প হয়ে গেল, সেটা দামেস্কের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বাঁকবদলের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের শাসকেরা দীর্ঘদিন ধরে আসাদকে তাঁদের বলয়ের বাইরে ফেলে রেখেছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটের বাইরে বেরিয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি (ভূমিকম্পের এক দিন পর) আসাদ মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতা আল-সিসির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। মিসরের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এটিই তাঁর প্রথম কথোপকথন।
এ ধরনের জমে বরফ হয়ে যাওয়া যুদ্ধে সাধারণত আগ্রাসনকারীরা লাভবান হয়। কেননা, তারা তাদের বিরোধী পক্ষের অনুপ্রেরণার উৎস শেষ করে দেয় এবং নিজ সমর্থকদের আকৃষ্ট করতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়। ঘটনাচক্রে আবার অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটে চলে। চাপ সৃষ্টির জন্য অন্য দেশগুলো যেসব সমাধান বের করছে, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ।
২০১৩ সালে মোহাম্মেদ মুরসির আমল থেকেই আসাদ সরকারের সঙ্গে মিসরের সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর দেশটিতে দুজন প্রেসিডেন্ট এসেছেন, কিন্তু কেউই আসাদের সঙ্গে কথা বলেননি।আরব বসন্তকালে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ দমাতে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন আসাদ। এর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের শাসকেরা তাঁকে উপেক্ষা করে এসেছেন। কিন্তু এতগুলো বছর বাদে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের একটা ঢেউ দেখা যাচ্ছে। এ থেকে বিশ্বের অন্যান্য অংশেরও অনেক কিছু শেখার আছে। নির্দিষ্ট করে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা যায়। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের এক বছর পেরোনোর পর এখন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীন ও ভারতও মেনে নিতে শুরু করেছে যে এ সংঘাত অনন্তকাল ধরে চলতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ ও সম্ভাব্য গতিমুখ কী হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা এক প্রকার কুস্তিই করছেন। সিরিয়ার শাসকদের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক কী হতে চলেছে, সেটা খুব ভালো করে নজরে আনা প্রয়োজন। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘাত হলেও বাইরের দেশগুলোর ওপর এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। গণ-বাস্তুচ্যুতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাঘাত, সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম—এ রকম বহু কিছু অনেক দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার ওপর গিয়ে অভিঘাত সৃষ্টি করছে, যেগুলো ভৌগোলিকভাবে সিরিয়া থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।
সিরিয়ার নানা গোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘাত এবং এসব সংঘাত যে সমস্যা সৃষ্টি করছে, তাতে আমাদের মনে হতেই পারে, যুদ্ধটা যেভাবে চলছে চলুক, আমরা শুধু শরণার্থী সমস্যা কিংবা সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে মাথা ঘামাব আর বাদবাকি সবকিছু ভবিষ্যতের জন্য তোলা রাখব। কিন্তু এসব সংঘাত যদি স্থায়ী রূপ নেয়, তাহলে রাজনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক—কোনোখানেই ক্ষমা পাওয়ার অবকাশ নেই; যার চাক্ষুষ প্রমাণ আমরা পেলাম ভূমিকম্পের সময়। এ ধরনের সংঘাত যত দিন স্থায়ী হবে, ততই এমন সব ঘটনা ঘটবে, যা পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা কল্পনাও করতে পারেননি।
ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এক বছর গড়াতে না গড়াতেই এটি স্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হবে কি না, সেই বিপদ তৈরি হয়েছে। দুই পক্ষই এখন সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে সংকল্প করেছে। রাশিয়া এখন নতুন করে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। আর পশ্চিমারা ইউক্রেনকে ট্যাংকসহ (সম্ভবত যুদ্ধবিমানও) নতুন অস্ত্রের জোগান দিতে প্রস্তুত হয়েছে। এ সংঘাত থেকে খুব শিগগির বেরিয়ে আসা যাবে, এমন কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
এ যুদ্ধে কোনো পক্ষ বড় বিজয় অর্জন করতে পারবে না। যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর প্রতিপক্ষকে ‘কৌশলগত পরাজিত’ করার যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা অর্জন বাস্তবে সম্ভব নয়। রাশিয়ার পরিপ্রেক্ষিত থেকে, ইউক্রেনের এই অচল যুদ্ধ যদি অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে, তাহলে মস্কোর জন্য সেটা একটা সমাধান হিসেবে আসতে পারে। ক্রিমিয়ার সংঘাতের কথা বিবেচনায় নেওয়া যাক। ২০২২ সালে এসেও সেটা একধরনের জমাট বেঁধে যাওয়া সংঘাত।
এ ধরনের জমে বরফ হয়ে যাওয়া যুদ্ধে সাধারণত আগ্রাসনকারীরা লাভবান হয়। কেননা, তারা তাদের বিরোধী পক্ষের অনুপ্রেরণার উৎস শেষ করে দেয় এবং নিজ সমর্থকদের আকৃষ্ট করতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়। ঘটনাচক্রে আবার অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটে চলে। চাপ সৃষ্টির জন্য অন্য দেশগুলো যেসব সমাধান বের করছে, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ।
অন্যদিকে সিরিয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যাত্রা শুরু হয়েছে। সেখানকার সংঘর্ষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনেক ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। জর্ডান ও লেবাননে ব্যাপক উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। তুরস্কে বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সিরিয়ার অভিবাসীদের ঢল নেমেছে। ফলে সেখানে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বেশ বড় অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সিরিয়াতে ইরানের হস্তক্ষেপ করার আরও সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব ঘটনাচক্র সিরিয়ার প্রতিবেশীদের মধ্যে এই চিন্তার জন্ম দিয়েছে যে অনন্তকাল ধরে অচলাবস্থা চলার চেয়ে দামেস্কের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করাই ভালো।
ইউক্রেনে একই ঘটনা ঘটে চলেছে। সংঘাতের এক বছরের মধ্যে অনেক হিসাব-নিকাশই বদলেছে। সেটা শুধু রাশিয়ার ক্ষেত্রেই নয়, চীনও এ ক্ষেত্রে বড় দৃষ্টান্ত। বাকি বিশ্বের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এ যুদ্ধ এখন জমে বরফ হয়ে গেছে বা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। সব অনুপ্রেরণা কিংবা পশ্চিমাদের সব সমর্থন তাতে ফিকে হয়ে আসছে।
সিরিয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকম্প কূটনীতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন চিন্তার জন্ম দিচ্ছে। এ থেকে শিক্ষা নিলে ইউক্রেন সংঘাতের মোড় হঠাৎ করেই ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব।
ফয়সাল আল ইয়াফি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত