বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মধ্যে গাজা এখন শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মধ্যে গাজা এখন শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক

মতামত

ইসরায়েল, গাজা এবং পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা

ইসরায়েলের ব্যাপারে পশ্চিমারা কি দ্বিচারিতা করছে? ইসরায়েল যা করে, তারই কঠোর সমালোচক তারা? গাজাকে রক্তে ভাসিয়ে দেওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে ‘ফেস দ্য নেশন’ নামের একটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘৭ অক্টোবরের মতো হামলা যুক্তরাষ্ট্রে ঘটলে তারা কী করত? ইসরায়েল যা করছে, তা-ই নয় কি? হয়তো তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটতে দেখতাম আমরা।’  

জেরুজালেম পোস্ট–এ র‌্যাবাই মারভিন হিয়া ইসরায়েলি বোমা হামলার বিরোধিতাকারীদের একহাত নিয়েছেন। তাঁর মতে, এই আচরণ অন্যায্য এবং দ্বিচারী। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানের বোমা হামলায় অগণিত বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি গাজার যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের নাকি বিচলিত করে না।

ওয়ার্ল্ড জিউইশ কংগ্রেস বলেছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষামূলক অভিযানের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়া, কিন্তু পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর একই ধরনের অভিযানের ব্যাপারে নীরব থাকা হলো অ্যান্টি–সেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষ। 

এসব আলোচনা একই সঙ্গে সত্য ও মিথ্যা, যুক্তিগ্রাহ্য আবার অযৌক্তিকও। কেন এসব যুক্তিকে আমার অসাড় মনে হয়, সে ব্যাপারে পরে আসছি। তবে এ কথা সত্য, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের নির্যাতন নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা ও তর্কবিতর্ক, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে ঠিক অত আলোচনা হচ্ছে না।

ইসরায়েলপন্থী একটি সংস্থা জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলের সমালোচনামূলক ১৫টি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, আর বিশ্বের বাকি দেশগুলোর বিরুদ্ধে ওই একই সময়ে উত্থাপিত হয় ৭০টি প্রস্তাব।  

বিশ্ববাসীর চোখ এখন গাজায় স্থির, কিন্তু সুদানের শিশুদের কথা সেভাবে উচ্চারিত হচ্ছে না। যদিও ইউনিসেফ বলছে, সুদানি শিশুরা ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার। এই সময়ে যত শিশু (৩০ লাখ) বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তা গাজার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীরা ধারাবাহিকভাবে গাজায় বোমা হামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কিন্তু সুদানে গত এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের কারণে মারাত্মক অপুষ্টির শিকার সাত লাখ শিশুর কথা অনেকেই ভুলে বসে আছেন। 

সিনেটর বার্নি স্যানডার্স বলছিলেন, ‘ইউক্রেনে বেসামরিক জনতার ওপর রাশিয়ার বোমা হামলার নিন্দা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নেতানিয়াহুর যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে অব্যাহতভাবে তহবিল জুগিয়ে যাচ্ছে?’

দুই দশক আগে সুদানের দারফুরে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটে, সেটিকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা বলে ধরা হয়। এখন এক দল অস্ত্রধারী আবারও হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। গ্রামে গ্রামে ঢুকে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ধর্ষণ করছে।

গণহত্যার সময় আমি দারফুর থেকে গণহত্যা নিয়ে লিখেছি। আমার ধারণা, সুদানের চলমান গণহত্যাকে বিশ্ব একরকম অগ্রাহ্যই করছে। তা ছাড়া আরব শাসকদের কেউ কেউ সিরিয়া ও ইয়েমেনে আরবদের ওপর মারাত্মক নির্যাতন চালিয়েছেন কয়েক বছর ধরে। 

তাহলে কি সত্যিই বিশ্ব একচোখা হয়ে যাচ্ছে? অবশ্যই। ইসরায়েলের সমর্থকেরা এসব যুক্তি দেখাতেই পারেন। তা ছাড়া কখনো কখনো যে ইহুদিবিদ্বেষের
ঘটনা ঘটছে না, তা–ও নয়। এখন চলুন মুদ্রার ওপিঠটা দেখে আসি। অন্যায্য ও বিদ্বেষের যত উদাহরণই হাজির করা হোক না কেন, কোনোভাবেই গাজার হাজার হাজার শিশু হত্যাকে যৌক্তিক বলার সুযোগ নেই।

আপনাদের এই যুক্তির সঙ্গে রাশিয়া যে যুক্তি দেখায়, তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ওই যে রাশিয়া বলছে, ‘আপনারা কীভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন, যখন নিজেরা ইরাক দখল করে সেখানকার মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছেন?’ 

হ্যাঁ। এ কথা সত্যি, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আন্দোলনে পক্ষপাতিত্ব দেখা গেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সবাই পক্ষপাত দেখিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলার সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা এসেছে জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে। আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোরই হাজারো কর্মী সুদান, ইথিওপিয়া ও অন্যান্য দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।

গাজায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়ার কারণ আছে। এটা শুধু বিপন্ন ও বেদনার্ত অনেকগুলো অঞ্চলের মধ্যে একটি অঞ্চল নয়। ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মধ্যে গাজা এখন শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক।

 ইউক্রেনে রাশিয়ার ১৮ মাসব্যাপী অভিযানে ৫৪৫ শিশু নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেসব যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৯৮৫ জন।

এর বিপরীতে গাজায় ইসরায়েলের পাঁচ মাসের কম সময় ধরে চলা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ১২ হাজার ৫০০ শিশু। এই শিশুদের মধ্যে ২৫০ জনের বয়স এক বছরের কম। আমি বিশ্বের এমন কোনো সংঘাতের কথা মনে করতে পারি না, যেখানে এমন অস্বাভাবিক দ্রুততায় এত শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। 

মানছি, ৭ অক্টোবরের হামলার সামরিক জবাব দেওয়ার অধিকার ইসরায়েলের আছে। অবশ্যই হামাস নেতাদের উচিত জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া। তার অর্থ এই নয় যে ইসরায়েল উপর্যুপরি বোমা হামলা চালিয়ে যেতে পারে। খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। ইসরায়েলি আক্রমণকে সমর্থন ও জাতিসংঘে তাদের কূটনৈতিক সুরক্ষা দেওয়ায় এই রক্ত এখন আমাদের হাতেও। অবশ্যই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।   

হ্যাঁ। দ্বিচারিতার আরও উদাহরণ আছে। আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য রাশিয়া, চীন, ভেনেজুয়েলাকে নিন্দা জানাই। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেই যেখানে ইসরায়েলের হামলাকে বাড়াবাড়ি বলছেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অব্যাহতভাবে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এটা তো স্পষ্ট দ্বিচারিতা। 

সিনেটর বার্নি স্যানডার্স বলছিলেন, ‘ইউক্রেনে বেসামরিক জনতার ওপর রাশিয়ার বোমা হামলার নিন্দা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নেতানিয়াহুর যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে অব্যাহতভাবে তহবিল জুগিয়ে যাচ্ছে?’

আমি বলি কি, দ্বিচারিতা নিয়ে সত্যিই কথা তোলা দরকার। আমরা তো দেখেছি, ইসরায়েলকে হরদম নিন্দা করেও সুরক্ষা দেওয়া যায়। কিন্তু এই বিশ্বে আমরা মানবতার স্বার্থে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি মানুষের চরিত্রের একটা দিক। কিন্তু কোনো যুক্তিতেই গাজায় শিশু হত্যা এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকা নিয়ে প্রশ্ন না তোলার অবকাশই নেই। 

নিকোলাস ক্রিস্টফ দ্য টাইমস–এর সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। চীন ও দারফুর গণহত্যা নিয়ে প্রতিবেদন করে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত