বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু এলাকায় সংকেতমূলক লাল পতাকা টাঙাচ্ছেন বিজিবির সদস্যরা
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু এলাকায় সংকেতমূলক লাল পতাকা টাঙাচ্ছেন বিজিবির সদস্যরা

দোরগোড়ায় মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, কী করবে বাংলাদেশ

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে, বিবদমান পক্ষগুলোর জন্য যেমন, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও। মিয়ানমার সেনাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায়। সীমান্ত পেরিয়ে আসা গোলাগুলিতে আগেই বেশ কয়জন আহত হয়েছিলেন বাংলাদেশের ভেতরে।

৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি মর্টার শেল বিস্ফোরণে দুজন নিহত হয়েছেন। একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তিন বছর আগে মিয়ানমার সেনারা নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে আধা গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চিকে সরিয়ে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তখন থেকেই নতুন পর্যায়ের সংঘাতের শুরু। সেনা কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল বরাবরের মতোই দমন–পীড়নের মাধ্যমে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এবারের প্রতিরোধের চরিত্র অন্য রকম।

জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করেন সু চির দল এনএলডির নেতারা। আর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় দীর্ঘদিন ধরে লড়াইরত বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গ্রুপ। প্রথমবারের মতো জাতিগত বিদ্রোহীদের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যের সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় গঠিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের বামার তরুণেরা অস্ত্র তুলে নেন সেনাদের বিরুদ্ধে।

গত অক্টোবর থেকে লড়াই তীব্র রূপ নেয়। প্রথমে শান রাজ্যের চীনা সীমান্ত এলাকার অনেক সেনাচৌকি দখল নেয় আরাকান আর্মি ও সহযোগী আরও দুটি দল নিয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। যুদ্ধ অনেক কাছে চলে আসে, যখন তারা বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের পালেতোয়া শহর দখল করে। সবশেষে বাংলাদেশের তুমব্রু, আলীক্ষং সীমান্তের লাগোয়া অঞ্চলে শুরু হয়েছে লড়াই।

বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ চলমান সংঘাত নিরসনে বা দিক পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখবে, তা নিশ্চয় কেউ আশা করেন না। তাহলে কী করবে বাংলাদেশ?

প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন বলেছেন, বাংলাদেশকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। উসকানি যেমনই হোক না কেন, বাংলাদেশের তরফ থেকে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া চলবে না, যাতে মনে হতে পারে বাংলাদেশ কোনো এক পক্ষের হয়ে কাজ করছে। মিয়ানমারে আমাদের মূল স্বার্থ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো।

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে, আমরা জানি না। তাই চলমান সংঘাতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভবিষ্যৎ আলোচনার টেবিলে নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়বে অন্তত দুটি দেশ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যায়, গৃহযুদ্ধের সমাপ্তিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করবে এমন ইঙ্গিত দিয়েছে চীন। এ কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবু কোনো সম্ভাবনাকেই বাতিল করা ঠিক হবে না।

দ্বিতীয়ত, আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাদের লড়াই চলছে উত্তর রাখাইন অঞ্চলে। রাখাইনে অবশিষ্ট যে দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা রয়ে গেছে, তাদেরও অধিকাংশের বাস এই এলাকাতেই। যদিও চলমান লড়াই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নয়, তবু যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

ফলে সীমান্ত পেরিয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে পারে। বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই আরেকটি শরণার্থীর ঢল গ্রহণ করতে পারে না। এ ধরনের কোনো প্রয়াস তাই যেকোনো মূল্যে রুখে দিতে হবে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের দৈর্ঘ্য তুলনামূলকভাবে কম। এই সীমান্তে অনেকটা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সামরিক সমাবেশ করে। বাংলাদেশের দিক থেকে একধরনের সশস্ত্র নিরপেক্ষতা (আর্মড নিউট্রালিটি) দৃশ্যমান হতে হবে।

চতুর্থত, বিগত বছর এবং মাসগুলোয় বাংলাদেশ শুধু মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে, অন্যান্য যে অংশীজন আছে, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ সূত্র রয়েছে বলে জানা যায় না। বাংলাদেশকে বাদ দিলে যে দুটি বৃহৎ প্রতিবেশীর স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে, তারা হচ্ছে চীন ও ভারত।

এর মধ্যে চীন একদিকে যেমন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, অন্যদিকে তেমনি আরাকান আর্মিরও ঘনিষ্ঠ। লড়াইটা বাস্তবে হচ্ছে চীনঘনিষ্ঠ দুটি পক্ষের মধ্যে।

ভারতের সঙ্গে সম্ভবত আরাকান আর্মির সুসম্পর্ক নেই। তবে ভারতও মিয়ানমারের নন-স্টেট অ্যাক্টরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। বিশেষ করে এনইউজি গঠন এবং আরাকান আর্মির উত্থানের পর থেকে আমি এবং আরও অনেকেই বলে আসছিলাম যে আমাদেরও এসব সংগঠনের সঙ্গে একটি বিকল্প বেসরকারি যোগাযোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

এরূপ একটি সূত্র থাকলে সীমান্তে চলমান সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি ওয়াকিবহাল থাকতে পারত, নীতিনির্ধারণে যা সহায়ক হতো।

অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং পরিস্থিতিও অনেক কঠিন হয়ে গেছে। তবু এনইউজি এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, চীন–ভারত উভয়েই এ রূপ কোনো উদ্যোগের বিরোধিতা করবে।

হয়তো তা–ই, কিন্তু মিয়ানমারে আমাদের স্বার্থ এবং এই দুই শক্তিমান বন্ধুর স্বার্থ আলাদা, এটা প্রমাণিত। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কখনো কখনো বন্ধুদের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নিতে হতে পারে। বাংলাদেশের বিগত নির্বাচন নিয়ে তো ভারত তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হয়নি।

পঞ্চমত, আরাকান আর্মির তাড়া খেয়ে মিয়ানমারের যেসব সেনা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের ফেরত পাঠানো নিয়ে সামরিক সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। যত দূর জানা যায়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো অনেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সেনা কর্তৃপক্ষ। এটা বাংলাদেশের বিষয় নয়। তবু বোধ হয় একটু খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত, আমরা এসব লোককে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাচ্ছি কি না।

সবশেষে যদিও মিয়ানমার সেনারা যুদ্ধে প্রতিপক্ষের কাছে অনেক ভূমি হারাচ্ছে, এরপরও আমি মনে করি না যে তাদের পরিপূর্ণ পরাজয়ের মাধ্যমে এই গৃহযুদ্ধের অবসান হবে। সব অনিশ্চয়তার মধ্যেও বেশি সম্ভাবনা থাকবে কোনো একপর্যায়ে, স্বেচ্ছায় বা শক্তিমান দেশগুলোর হস্তক্ষেপে, আলোচনার টেবিলে সংঘাতের নিষ্পত্তির।

সেই আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে দুটি সংগঠন, এনইউজি এবং আরাকান আর্মি। এনইউজি রোহিঙ্গা প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরাকান আর্মির তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তবে সম্প্রতি তাদের অবস্থান খানিকটা নমনীয় হয়ে থাকতে পারে। ভবিষ্যৎ আরাকান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করা হবে, এমন একটি আওয়াজ তারা দিয়েছে। এসব ইঙ্গিতকে গুরুত্ব দিয়ে এগোনো প্রয়োজন বাংলাদেশের।

একটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য বলে মনে হয় আমার কাছে। যারা যুদ্ধ করে, ত্যাগ–তিতিক্ষার বিনিময়ে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে, তারা কি যারা সাইডলাইনে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছে, তাদের সঙ্গে সেই বিজয়ের ফল সমভাবে ভাগ করে নিতে আগ্রহী হবে?

ভবিষ্যৎ আলোচনার টেবিলে নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়বে অন্তত দুটি দেশ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যায়, গৃহযুদ্ধের সমাপ্তিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবর্তনে সহায়তা করবে এমন ইঙ্গিত দিয়েছে চীন। এ কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবু কোনো সম্ভাবনাকেই বাতিল করা ঠিক হবে না।

সম্ভবত আলোচনার টেবিলে ভারতেরও কিছু ভূমিকা থাকবে। অবিলম্বে জোরালো নীরব কূটনীতি শুরু করা দরকার এই দেশগুলো এবং তার পাশাপাশি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেও, যেহেতু সংকট নিরসনে তাদেরও জোরালো ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা। বাংলাদেশকে অবিচল থাকতে হবে মূল লক্ষ্যে, সম্ভাব্য নতুন মিয়ানমারে যাতে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে পারে নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে।

● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব