আনিসুল হকের কলাম

‘‌ঘুষ নেয় না শুধু বোকারা’

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বলেছেন এ কথা। এখন যে কর্মকর্তারা ঘুষ নেন না, তাঁরা সংখ্যালঘু। তাঁদের পরিচয় এখন তাঁরা বোকা, তাঁরা দুর্বল। তিনি বলেছেন, আগে মানুষ মনে করতেন, একটি বিশেষ বাহিনী ঘুষ খায়, আর এখন এমন কোনো দপ্তর নেই, যেখানে ঘুষ খাওয়া হয় না। ১৩ জুন ২০২৩ জাতীয় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, সব জায়গায় সিন্ডিকেট করে ওই কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেন। টাকা না দিলে কাজ হয় না। মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, যাঁরা বিদেশে টাকা পাচার করে বেগমপাড়ায় বাড়ি করেছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ আমলা বলেও দাবি করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া। তিনি আরও দাবি করেন, এখন বড় বড় রাঘববোয়াল টাকা বা ডলারে ঘুষ খান না। তাঁরা সোনার বারে ঘুষ নেন। এই সংসদ সদস্য বলেন, এত দিন শোনা যেত, কানাডায় বেগমপাড়া। কয়েক দিন আগে দেখা গেল, লন্ডনে বেগমপাড়া। বেগমপাড়া বলতে মানুষ মনে করে, এটা সংসদ সদস্যরা করেছেন। এটা ঠিক নয়। যাঁরা টাকা পাচার করে বিদেশে বাড়ি করেছেন, যাঁদের কারণে বেগমপাড়া নামটি এসেছে, তাঁদের ৯০ শতাংশই আমলা।

গোলাম কিবরিয়ার এসব কথায় কেউ প্রতিবাদ করেছেন বলে শোনা যায়নি।  অবশ্য তিনি এমন কোনো গোপন কথা বলেননি, এমন কিছু নতুন আবিষ্কারও করেননি। গোলাম কিবরিয়া বলেছেন, আগে মানুষ মনে করতেন, একটি বিশেষ বাহিনীর লোকেরা শুধু ঘুষ খান। জানি না, তিনি কোন বাহিনীর কথা ভেবেছেন। হুতোম প্যাঁচার নকশায় আছে, ‘পুলিশের সার্জন-দারোগা-জমাদার প্রভৃতি গরিবের যমেরা থানায় ফিরে যাচ্ছেন; সকলেরই সিকি, আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক ও পকেট পরিপূর্ণ।’ রবীন্দ্রনাথ নাকি আমি যখন পুলিশ ছিলাম-এর লেখক পঞ্চানন ঘোষালকে বলেছিলেন, ‘পুলিশ যদি কারোর পা-ও জড়িয়ে ধরে তো লোকে মনে করে যে পুলিশ তার জুতো জোড়াটা সরাবার মতলব করছে।’

ঢালাওভাবে কথা বলব না। সব পেশাতেই ভালো মানুষ আছেন। সব পেশাতেই কিছু না কিছু মন্দ লোক থাকার কথা। আমলাদের দুর্নীতির ইতিহাস অতিপ্রাচীন। আকবর আলি খান পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন: চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের বয়সও প্রায় দু হাজার বছর হবে। চাণক্য লিখেছেন, সরকারি কর্মচারীরা দু’ভাবে বড়লোক হয়: হয় তারা সরকারকে প্রতারণা করে, অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে সরকারি কর্মচারীদের চল্লিশ ধরনের তছরুপের ও দুর্নীতির পন্থা চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে সজাগ থাকা সত্ত্বেও চাণক্য রাজস্ব বিভাগে দুর্নীতি অনিবার্য মনে করতেন।

দুর্নীতি এখন নীতিতে পরিণত হয়েছে। ঘুষ হয়ে উঠেছে সমাজের স্বাভাবিক এক আচার। এর চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার ঘটছে। ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা, হাজার কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে বেনামি প্রতিষ্ঠান। এরপর তারা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। দেশে ডলার নেই, অথচ দেশের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক দুর্নীতি ছিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দুর্নীতির জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন—
‘সরকার হইলা কাল খিল ভুমি লিখে লাল
বিনা উপকারে খায় ধুতি’

আকবর আলি খান এ প্রবন্ধে আরও লিখেছেন ব্রিটিশ আমলের আসানসোলের মহকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটের কথা। মাইকেল ক্যারিটকে পাঞ্জাবি ঠিকাদার বলেছিল, ‘হুজুর এ দেশে তিন ধরনের মানুষ আছে। যারা ঘুষ খায় না। যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে। আর তিন নম্বর দলে আছে কিছু শুয়োরের বাচ্চা, যারা ঘুষও খায় কিন্তু কাজ করে দেয় না।’

শুধু কি আমলারাই ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ ‘খানা’ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ভূমিসেবা ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ। (ডেইলি স্টার, আগস্ট ৩১, ২০২২)

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, ‘রাজা অত্যাচারী হয়, এটা আমরা শুনে এসেছি। কিন্তু রাজা চোর হয়, এটা কি আমরা আগে শুনেছি? নিজের ঘর থেকে কেউ চুরি করে?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু “দুই বিঘা জমি” কবিতায় রাজার চুরির কথা লিখে রেখে গেছেন, “এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি!/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।”’

এখনকার বাংলাদেশে এটাই প্রধান সমস্যা বলে মনে হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের যে একটা বড় বিপ্লব করার অঙ্গীকার ছিল, সে কথা আমরা ভুলেই গেছি। ভুলে গিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছি দুর্নীতিতে প্রতিযোগিতায়। কে কার চেয়ে বেশি খেতে পারবে, চলছে সেই রেস। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-তে গুচ্ছ-১-এর ১ নম্বর অঙ্গীকার ছিল, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স।’ আজকের দিনে এসে হিসাবের খাতা বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার ঘরে পড়েছে শূন্য।

বরং দুর্নীতি এখন নীতিতে পরিণত হয়েছে। ঘুষ হয়ে উঠেছে সমাজের স্বাভাবিক এক আচার। এর চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার ঘটছে। ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা, হাজার কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে বেনামি প্রতিষ্ঠান। এরপর তারা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। দেশে ডলার নেই, অথচ দেশের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে।

আর ঘুষ-দুর্নীতি কেবল আমলাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন একটা রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের ইউনিয়ন কমিটিতে জায়গা পেতেও টাকা সাধতে হয়। নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে লেনদেন হয় এবং নির্বাচনী বৈতরণি পার হতেও লাগে গুচ্ছের টাকা। আজকে দেশে যে লোডশেডিং, ডলার-সংকট, মূল্যস্ফীতি—এসবের আদি কারণ এই দুর্নীতিই। আমরা কোনো প্রকল্প জনগণের উপকার হবে বলে গ্রহণ করি, নাকি তা থেকে আমার নিজের কী লাভ হবে, সেই কথা ভেবে প্রণয়ন করি? ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।

আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে। [প্রথম আলো, ১০ এপ্রিল ২০২৩] সাত-আট বিলিয়ন ডলার পাচার যদি না হতো, তাহলে দেশে কি আজকে রিজার্ভে টান পড়ে? আর পাচার হয় কোন টাকা? বেশির ভাগই ঘুষের টাকা, দুর্নীতির টাকা, ব্যাংক-লুটের টাকা।

অন্য দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় রোজ মানুষ মারা যাচ্ছে। এর পেছনেও কিন্তু আছে দুর্নীতি। এর কারণে অযোগ্য যানবাহন ফিটনেস সার্টিফিকেট পায়, দুর্নীতির কারণে অযোগ্য চালক লাইসেন্স পায় বা লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায়, দুর্নীতির কারণে রাস্তা এবড়োখেবড়ো হয়।

এ লেখার শিরোনাম ‘ঘুষ নেয় না শুধু বোকারা’ কথাটা অতিসরল। সৎ মানুষ এ দেশে এখনো আছেন। তাঁরা বোকা নন, তাঁরা আদর্শবাদী। ৯৯ শতাংশ লোক তাঁদের বোকা বলেই জানবেন। এখন ৯৯ শতাংশ লোক যেন তাঁদেরই আদর্শ বলে মানেন, সেই কাজটা শুরু করতে হবে। কাজটা করা দরকার ওপর থেকে।

গাছের গোড়া কেটে ওপরে পানি দিয়ে লাভ নেই, তা-ও আমরা জানি। তাহলে গোড়া থেকেই শুরু হোক।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক