পলিটিকো লিগ্যাল ইকোনমির মতো আন্তশাস্ত্রীয় আলোচনা খুব হতে দেখা যায় না। এ আমাদের বিদ্যায়তনিক সীমাবদ্ধতা। পলিটিকো লিগ্যাল ইকোনমির ত্রিবিধ আলোচনার অভিমুখ হচ্ছে আইন (সংবিধান) অর্থনীতি ও জনগণ। সেই ধারায় বাজেট যতটা না অর্থনৈতিক রোডম্যাপ, তার চেয়ে বেশি অর্থনীতির পথে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার প্রক্রিয়া।
‘অজনগণকরণের’ প্রথম ও প্রধান শিকার হয়ে থাকে জনগণ। জনগণকে জনগণকরণ একপ্রকারের সাধারণীকরণ বা সামান্যীকরণ। প্রায় অস্বীকারের মতো এক প্রপঞ্চ। আর অজনগণকরণ শাব্দিক বিচারে জনগণকরণের বিপরীত হলেও সামষ্টিক জনগণকে নিশ্চিহ্নকরণের এক ধরন বা প্রক্রিয়া। অজনগণ (আনপিপল) পরিভাষাটি কার্ল মার্ক্স, জর্জ অরওয়েল আর নোয়াম চমস্কির চিন্তাবাহিত হয়ে বিরাজ করছে সামাজিক বিজ্ঞানের ডিসকোর্সে। প্রতিবার বাজেট মানে গ্রহণ–প্রত্যাখ্যানের চেনা বাইনারির বাহাস। এবারে মানুষ এতই বিক্ষিপ্ত যে অতি দরকারি রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে দুই হাজার টাকার বোঝার আবশ্যকীয় ভারও মালুম করতে পারছে না।
জনগণের অধিকারের দিকনির্দেশনা দেওয়া থাকে সংবিধানে। প্রায়শই জনগণকে তাদের সাংবিধানস্বীকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় রাষ্ট্রের অপারগতায় কিংবা আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের সক্রিয়তায়। যার সাম্প্রতিক নজির করযোগ্য আয় অতিক্রম না করলেও দুই হাজার টাকা জমা দিতে হবে। বিনিময়ে স্বীকার করা হবে উন্নয়নে অবদান রাখছে দুই হাজার টাকা প্রদানকারী জনগণ। যদিও সাংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ জনগণকেন্দ্রিক ম্যান্ডেট যেখানে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।
বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাতের শোচনীয়তা দেশের দুর্বল কর সংস্কৃতির স্মারক। এটি সত্য বিনিয়োগ বাড়াতে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির অন্য বিকল্প নেই। কর আদায় বাড়াতে সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির ফলে সরকারকে আগামী অর্থবছরে ভালো পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে হবে। সিপিডির হিসাব বলছে, আগামী বছরে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে হলে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত যতটা রাজস্ব আদায় হয়েছে, তার তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি আদায় করতে হবে। তাই সরকার মরিয়া হয়ে দুই হাজার টাকা আদায়ে নেমেছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায়, বিশেষ করে রাজস্ব আদায়, আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা, অর্থনীতির অন্যান্য জায়গায় যে সংকট আছে, সেগুলো সামলে নেওয়ার জন্য কী করা উচিত, সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না। সরকারি সেবা নাগরিকের সাংবিধানিক ন্যায়সংগত অধিকার। সেখানে এ রকম শর্ত আরোপ করা মোটেই যৌক্তিক নয়, সাংবিধানিক কি? যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ একে বলেছেন, এই বিধানের অনৈতিকতা সংশয়াতীত। (সূত্র: প্রথম আলো)
ডলার–সংকট, মূল্যস্ফীতি, আইএমএফের শর্ত—এমন নানা বাস্তবতা মাথায় রেখে এবারের বাজেট পেশ করতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। পরিসংখ্যানের বাহাদুরি আমাদের সরকারকে আত্মতৃপ্তির অযৌক্তিক সুযোগ করে দেয়।এই অনায়াস মোহ থেকে নীতিনির্ধারকদের বের হওয়ার কোনো ইচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। এ মোহ থেকে বের হওয়া জরুরি যদি বাস্তবিকই অবস্থার পরিবর্তন চায়। যৌক্তিক রূপান্তর আশা করলে বাস্তবসম্মত নীতি কৌশল প্রণয়ন করা ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ যতই এলডিসি উত্তরণের পথে এগোচ্ছে, ততই এটি আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার প্রেস্ক্রিপশন মেনে বিনিয়োগকারীদের কর প্রণোদনা প্রদান করছে। বিপরীতে স্বল্প আয়ের মানুষের ঘাড়ে করের জোয়াল চাপিয়েছে। যদিও উচ্চ উপার্জনকারী মানুষ এবং বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে জনসাধারণের পরিষেবা ও সামাজিক সুরক্ষার অর্থায়নে অবদান রাখা উচিত কিন্তু ঘটে আসলে উল্টো।
এক সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধির অহংকারে আচ্ছন্নে পার করা দেশ যদিও আইএমএফের কাছ থেকে খাসলত (নীতিচর্চা) বদলানোর ‘মুচলেকা’ দিয়ে টাকা ধার করতে হয়েছে। এই বাজেটেও জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ ধরা হয়েছে, স্বাভাবিক বিচার–বিবেচনা প্রয়োগ করে বলা যায়, এই লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি যেটাকে উচ্চাভিলাষী বলে দেখছেন বিশ্লেষকেরা, র্যাডিকেল স্কুলের সমর্থকেরা বলেন অযৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা।
বাংলাদেশের বিদ্যমান কর সংস্কৃতি মোটেই ভালো নয়। উদ্ভাবনী সৃজনশীলতামূলক অর্থনৈতিক চিন্তা আমাদের আয়করব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। এই বাজেটে আয় বিবেচনায় না নিয়ে রিটার্নের সঙ্গে দুই হাজার টাকা জমার টোটকা দাওয়াই সরকারের প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাড়তি অর্থারোপ নিম্ন আয়ের মানুষদের অতি দরকারি সেবা গ্রহণে অনীহ করলে শেষবিচারে ক্ষতি তো সরকারেরই।
বাংলাদেশ যতই এলডিসি উত্তরণের পথে এগোচ্ছে, ততই এটি আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার প্রেস্ক্রিপশন মেনে বিনিয়োগকারীদের কর প্রণোদনা প্রদান করছে। বিপরীতে স্বল্প আয়ের মানুষের ঘাড়ে করের জোয়াল চাপিয়েছে। যদিও উচ্চ উপার্জনকারী মানুষ এবং বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে জনসাধারণের পরিষেবা ও সামাজিক সুরক্ষার অর্থায়নে অবদান রাখা উচিত কিন্তু ঘটে আসলে উল্টো।
আমাদের সংবিধানে ‘রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব’ হিসেবে নাগরিকদের ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নাগরিকদের মৌল উপকরণের ব্যবস্থার কথা বলা আছে। দেশের এক বিশাল অংশ নিদারুণভাবে এই সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। স্বীকার করতে হবে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি হয়েছে (গুণগত মান বিবেচনা করা হচ্ছে না)। তবে সব শিশুকে শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিতে এর সঙ্গে সংবিধানে উল্লিখিত ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার’-এর বিষয়টিও জড়িত। সর্বজনীন শিক্ষার সুযোগ থাকলেও সে সুযোগ নিশ্চিতের আগে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর ন্যূনতম জীবনধারণের সংস্থানের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
বাংলাদেশের মতো স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য সংগ্রামরত অন্য অনেক স্বল্পোন্নত দেশের সাংবিধানিক মূলনীতিতে নাগরিকদের সমান সুযোগ ও সামাজিক নিরাপত্তার উল্লেখ থাকলেও তা কেবল ‘দিকনির্দেশনামূলক’, যে কারণে আদালতের মাধ্যমে তা নিশ্চিতকরণে আইনি সাহায্য পাওয়া যায় না। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে অনুচ্ছেদ ৮(২)-এ বলা হয়েছে, ‘এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূল সূত্র হইবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকের কার্যের ভিত্তি হইবে। তবে এসব নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।’
আসলে ভাত দেবার মুরোদ নেই এবং এ বিষয়ে আন্তরিক না। অন্যদিকে কিল মারার গোঁসাই হয়ে করযোগ্য আয় না হলেও বাধ্যতামূলকভাবে দুই হাজার টাকা কোষাগারে দিতে হবে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত ব্যর্থ হলে দায় এড়ানোর ব্যবস্থা করে রেখেছে [অনুচ্ছেদ ৮(২)] অথচ নাগরিকদের বাধ্য করছে দুই হাজার টাকা দিয়ে উন্নয়নে শামিল হতে। এই বিতর্কিত ও অযৌক্তিক নির্দেশনা কতটা সাংবিধানিক সে প্রশ্নের মীমাংসার জন্য সাংবিধানিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন যে কেউই।
এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ই–মেইল: adv.mmkzaman@gmail.com