মতামত

পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ভণ্ডামি নয় কি

ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি : রয়টার্স

আমার এই লেখায় যাঁদের আস্থা আছে, তাঁরা জানেন আমি ভণ্ডামি নিয়ে বিস্তর লিখেছি। ভণ্ডামি আমাকে কখনো বিষাদগ্রস্ত করে, কখনো আঘাত করে, কখনো রাগিয়ে দেয়। কিন্তু রাষ্ট্র অনুমোদিত দ্বিচারিতা বা ভণ্ডামি আমাকে কখনো অবাক করতে পারে না। যেখানেই রাষ্ট্রের ভণ্ডামি বা দ্বিচারিতার ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে আমি এই কারণে উচ্চকিত থাকি, যাতে ভণ্ডরা এবং তাদের সহযোগীরা অন্তত জানতে পারে, তাদের দুমুখো সাপের মতো ভণ্ড আচরণ সবার সামনে খোলাসা করার মতো কেউ না কেউ এখনো আছে।

আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ভণ্ডামির সাত-সতেরো বলা শুরু করব, আর সেটি আমাকে হোয়াইট হাউস, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পেন্টাগনের ভণ্ডামির দরজায় পৌঁছে দেবে। গত সপ্তাহে আইসিসি এক রায়ে বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর থেকে এ পর্যন্ত লাখ লাখ ইউক্রেনীয় শিশু অপহৃত ও জোরপূর্বক ভিটেচ্যুত হয়েছে। আইসিসি বলেছেন, এগুলো যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আদালত একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের দায়ে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। 

আইসিসি বলেছেন, পুতিন এবং অপর একজন রুশ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে ইউক্রেনের শিশুদের বাস্তুচ্যুতির জন্য দায়ী। আইসিসি পুতিনের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সাফাই দিতে গিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এই গ্রেপ্তারের আদেশ ইউক্রেনে আরও যুদ্ধাপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে জনমত গঠনে সহায়ক হবে। পশ্চিমা ও ইউরোপিয়ান রাজধানীগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম স্থায়ী দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তার করার এই আদেশে উল্লাস প্রকাশ করেছে। পশ্চিমা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকেরা আইসিসির এই আদেশকে পুতিনের ‘আগ্রাসনমূলক অপরাধ ঠেকানোর প্রথম প্রতিরোধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আইসিসির রায়ের এখতিয়ারকে মস্কো যদিও স্বীকৃতি দেয় না, তবু এর প্রতীকী গুরুত্ব আছে। কেউ আমাকে পুতিনের দালাল ও ভাঁড় বলে গালি দেওয়ার আগেই বলে রাখি, পুতিনের নৃশংসতা নিয়ে এ পর্যন্ত আমি অনেক লেখালেখি করেছি। আমি খুশি যে পুতিনকে আইসিসি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে রায় দিয়েছেন। কারণ, এটি তাঁর প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এই রায় ঘোষণার মধ্যে গভীর ভণ্ডামি রয়ে গেছে। কারণ, রাশিয়াকে যে অপরাধের দায়ে দণ্ডিত করা হচ্ছে, সেই একই অপরাধ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ অন্য দেশের নেতারা দিনের পর দিন করেও আইসিসির দণ্ডাদেশ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাচ্ছে।

আইসিসি যদি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া অথবা ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে আমলে নিতেন এবং ইতিপূর্বে সাবেক সরকারপ্রধানদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতেন, তাহলে আদালতের ‘এই রায় ভবিষ্যতের যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমাতে সহায়ক হবে’ বলাটা গ্রহণযোগ্যতা পেত। যেহেতু এই আদালত ইতিপূর্বে এসব দেশের বিরুদ্ধে কখনো মুখ খোলেননি, সেহেতু পুতিনের কাছে এই রায়ের কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু ভণ্ডদের সরদার জো বাইডেন ঠিকই এই রায়কে ‘ন্যায়বিচার’ বলে স্বাগত জানিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত অসংখ্য আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নির্দেশে অগণিত আমেরিকান সেনা বিভিন্ন মহাদেশে গোপন অভিযান চালিয়ে খুন ও অপহরণ করেছে, কিন্তু আইসিসি কোনো দিনই তঁাদের যুদ্ধাপরাধী বলেনি। একজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সেনারা তাঁদের ইভানজেলিক্যাল আমেরিকান জ্ঞাতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে অগণিত শহর ধ্বংস এবং লাখ লাখ শিশু-নারীকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করেছে; কিন্তু এই আইসিসি কখনো তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করেননি। 

অস্ট্রেলিয়ার কথিত এলিট সেনাবাহিনী আফগান নারী, শিশুসহ ৩৯ জন আফগান বন্দীকে ঠান্ডা মাথায় গলা কেটে হত্যা করার পর, তার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েও আইসিসি কখনোই সেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেননি। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীদের নির্দেশে ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর, জেরুজালেম, গাজা এবং পাশের দেশ লেবাননে দখল অভিযান চালিয়ে নারী ও শিশুদের ভিটেছাড়া করছে, তাদের হত্যা করছে; কিন্তু সেখানেও আইসিসির বিবেচনায় কখনো কোনো দিন যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি।

আইসিসি যদি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া অথবা ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে আমলে নিতেন এবং ইতিপূর্বে সাবেক সরকারপ্রধানদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতেন, তাহলে আদালতের ‘এই রায় ভবিষ্যতের যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমাতে সহায়ক হবে’ বলাটা গ্রহণযোগ্যতা পেত। যেহেতু এই আদালত ইতিপূর্বে এসব দেশের বিরুদ্ধে কখনো মুখ খোলেননি, সেহেতু পুতিনের কাছে এই রায়ের কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু ভণ্ডদের সরদার জো বাইডেন ঠিকই এই রায়কে ‘ন্যায়বিচার’ বলে স্বাগত জানিয়েছেন।

যেহেতু পশ্চিমা অপরাধকে চোখে দেখতে পান না, শুধু পুতিনের অপরাধই তাদের চোখে পড়ছে, সেহেতু এই পরোয়ানা যে নির্জলা ভণ্ডামি, তাতে সন্দেহ নেই।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা আল–জাজিরার কলাম লেখক