সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একটি বাংলা পত্রিকার সঙ্গে সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর ১০ বছরের কর্মকাল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন করা যায়। তাঁর সাফল্য এটুকু যে কোনো বিরোধে না জড়িয়ে তিনি ক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রকদের সুনজরে থাকতে সক্ষম হয়েছেন।
এটা করতে গিয়ে পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের জনগণের ভোটাধিকার উপেক্ষিত হওয়া, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুম-খুনের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো সম্পর্কে তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেননি, এটাও বলতে হবে। বলতে হবে ছোটখাটো কারণে চিকিৎসা নিতে বেমানান সংখ্যায় সঙ্গী নিয়ে তাঁর বিদেশ সফরের কথাও। এর মাধ্যমে তিনি শুধু রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং দেশের বিদ্যমান চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থায় চিড় ধরিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতা দিয়েছে— এ বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে এ পদের একটি বিশালত্ব রয়েছে। এর নৈতিক জোরের বিষয়টিও নেহাত কম নয়। সেদিকে তিনি চলেননি। অবশ্য এ নিবন্ধ তাঁর কার্যকালের সাফল্য-ব্যর্থতা বিবেচনা করার উদ্দেশ্যে নয়। বিদায় নেওয়ার পর আলোচ্য সাক্ষাৎকারে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন।
যেমন ক্ষমতায় যেতেই হবে—এ মানসিকতা বর্জন, বিভিন্ন দেশকে আমাদের সমস্যা সমাধানে ডেকে আনা, ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিদের সুবিধা অনুযায়ী দল বদল, সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বের হার একতরফাভাবে বেশি হওয়া আর সচিব ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের অবসরে গিয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখা ইত্যাদি।
বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কথাগুলো যিনি বলেছেন, তিনিও গুরুত্বপূর্ণ। কথা আসতে পারে, ক্ষমতায় থাকাকালে এসব বিষয়ে টুঁ–শব্দ না করে এখন কথাগুলো কেন বলছেন। এখানে বলা চলে, কখনো কিছু না বলে ন্যায্য কথা কোনো এক সময়ে এসে কিছুটা বলাও ভালো। অন্তত ভাবনার খোরাক তো রইল। তাই তাঁর বক্তব্যগুলো কিছু অংশ আলোচনার আবশ্যকতা রয়েছে।
সচিব ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে গিয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখা বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত নেই। এ ক্ষেত্রে আবদুল হামিদ সংগতভাবেই বলেছেন, এমনই যদি হয়, মাঠপর্যায়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা পাবেনটা কী? সমস্যাটিও তিনি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ১৯৯১ সালে তাঁর দল আওয়ামী লীগ রাজনীতির বাইরের লোকদের মনোনয়ন দেয়নি বলে হেরে গিয়েছিল।
পক্ষান্তরে ‘বড় বড় জেনারেল, সচিব ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের’ মনোনয়ন দেয় বিএনপি। জয়ী হয়েছিল তারাই। বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন এমনিভাবে পাল্টে যায়। বিজয়ী হয় তারা। আর ‘ক্ষমতায় যেতেই হবে’—এ মানসিকতা থেকেই তো তা হয়েছিল। এমনটা বলা চলে। তিনি কিন্তু তখন সে সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। এ ধারার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ তাঁর ছিল, এমনটা আমরা শুনিনি।
অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, আবদুল হামিদ তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত হওয়া একজন রাজনীতিক। রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন বিবেচনার জন্য সংসদীয় বোর্ড থাকে। হতে পারে সেগুলো বর্তমানে তেমন কার্যকর নয়। তবু বলতে হবে, এসব বোর্ডে এখনো মূলত রাজনীতিবিদেরাই আছেন। আর তাঁদের হাত ধরেই তো এখন সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব ১৯৭০-এর ২ শতাংশ থেকে এখন ৬২ শতাংশ।
ব্যবসায়ী হওয়া দোষের কিছু নয়। তেমনি দোষের নয় সচিব বা জেনারেল হওয়া। তাঁদের কারও মধ্যে রাজনৈতিক পদ-পদবি লাভের সুপ্ত বাসনাও অস্বাভাবিক নয়। তবে আমাদের দেশে মাত্রাতিরিক্ত হারে তাঁদের পথ করে দিচ্ছেন রাজনীতিবিদদের একটি অংশ, এমনটি বলা অমূলক হবে না। সুতরাং সংসদে সংখ্যায় তাঁদের আধিক্য থাকা দুর্বল রাজনৈতিক কাঠামোয় স্বাভাবিক। গত দুটি নির্বাচনের ধারা এ ধরনের প্রতিনিধিত্বকে আরও উৎসাহী করে তুলেছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের অবসর গ্রহণের পর সক্রিয় রাজনীতিতে আসার নজির অনেক দেশেই আছে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি মিত্রবাহিনীর পশ্চিম কমান্ডের প্রধান পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন পরপর দুবার। ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে অবসরজীবী কর্মকর্তারা, এমনকি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিও রয়েছেন। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীও অবসর গ্রহণের পরপরই সরাসরি মন্ত্রী ও পরে রাজ্যসভার সদস্য হন। পশ্চিমবঙ্গের বাম জমানার অবসানের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরাজিত হন তাঁর সাবেক মুখ্যসচিবের কাছে।
আমাদের দেশের একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অবসর নিয়ে একটি দলে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়ে যান। অবশ্য প্রশাসনে রাজনীতিকরণ সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করা হয়। আর এ রাজনীতিকরণের দায় রাজনীতিকদেরই। অবশ্য এটা সমীচীন হয় বলে আমি দৃঢ়ভাবে ধারণা করি।
‘আমাদের লোক আর ওদের লোক’ তত্ত্বটা চালু রাজনীতিকদের। আর এখন এটার কর্তৃত্ব প্রজাতন্ত্রের একশ্রেণির কর্মচারীদের হাতে। তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা সেটা দেখতে ও বুঝতে পারেন। কিন্তু তাঁদের দলের সংসদ সদস্যদের একটি অংশ ইউএনও, ওসিদের পেছনে না ঘোরালে পুরো কর্তৃত্ব জাহির হয় না বলে মনে করেন। যাঁরা সম্ভব ডিসি-এসপিদেরও এভাবে ঘোরান। সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষমতার কলকাঠি একপর্যায়ে তাঁরাই নাড়াতে চাইবেন, এটা অসংগত হলেও অস্বাভাবিক নয়।
সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সময়কালে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর গুণগত দিক দেশ-বিদেশের উৎসাহী সবাই জানেন। এখন ২০২৪-এ আরেকটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো একই রকম অনমনীয় অবস্থানে যাচ্ছে। বিদেশি শক্তি বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়ছে এ ব্যবস্থায়।
সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতির আরেকটা কথা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। আমেরিকা, চীন, রাশিয়াকে ডেকে কাজ হবে না।’ ‘সংলাপে সংকটের সমাধান। ছাড় দিতে হবে সবাইকে।’ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো লোক তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করবেন না। তবে আমরা কী দেখেছি ও কী দেখছি। এরশাদ জমানার মাঝামাঝি থেকে এ ধারা শুরু। এরশাদের পতনের পর বিষয়টি ভিন্নতর হবে বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু দেখা যায়, আরও ভয়াবহভাবে জোরদার হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ জোট। বিপরীতে সরকারে বিএনপি। অবস্থান ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথসহ বহুজাতিক অনেক সংস্থাকেও আমরা সংশ্লিষ্ট করেছি আমাদের সমস্যা সমাধানে। একপর্যায়ে সমাধান হয় তখনকার মতো।
২০০৬-এর শেষ দিকে এসে একই অবস্থা। দেশবাসী স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া—সবই ডুবতে বসেছিল। তখন ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের দৃশ্যমান তৎপরতা আমাদের রাজনীতিকদের চেয়ে কিছু একটা কম ছিল না। অচলাবস্থার সূচনায় সংলাপ কিছুটা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতির প্রতিষ্ঠানটি তখনো কার্যকর দেখা যায়নি।
অথচ এটা হতে পারে অত্যন্ত শক্তিশালী আম্পায়ার। তখনকার অচলাবস্থার অবসান ঘটায় নন্দিত-নিন্দিত এক-এগারো। ২০০৯-পরবর্তী সময়কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান সংশোধনে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আমরা দেখেছি অনেকটা যান্ত্রিক। এর বিষময় পরিণতি সম্পর্কে এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশ্যে বা গোপনে সরকারি দলকে সংযত হতে বলা সম্ভব ও সংগত ছিল, কিন্তু এমন কিছু হয়নি।
সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সময়কালে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর গুণগত দিক দেশ-বিদেশের উৎসাহী সবাই জানেন। এখন ২০২৪-এ আরেকটি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো একই রকম অনমনীয় অবস্থানে যাচ্ছে। বিদেশি শক্তি বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়ছে এ ব্যবস্থায়।
সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি তাঁর কর্মকালে বিষয়টি দেখে এসেছেন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি সদালাপী এবং অহংবোধবর্জিত। তাঁর শেষ বছরটায় একটি সফল সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সমাধান করতে তিনি প্রচেষ্টা নিতে পারতেন। সব প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না। তা-ও প্রশংসিত হয় জনমনে।
তিনি জানেন, ২০০৮-এ যাঁদের বয়স ১৮ বছরের নিচে ছিল, তাঁদের সংখ্যা কয়েক কোটি। তাঁদের বিশাল অংশ কিন্তু কোনো জাতীয় নির্বাচনে একবারও ভোট দেননি। এটাও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি কিছু করেননি। তবু দায়িত্ব শেষে হলেও কিছু ন্যায্য কথা বলার জন্য সাধুবাদ দেব।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com