১ মে রাষ্ট্রীয় ছুটি ছাড়া কী চেতনা অবশিষ্ট আছে এ দিবসের? কাগজে–কলমে যা–ই থাকুক, আনুষ্ঠানিক খাতে পর্যন্ত কর্মঘণ্টা আটের মধ্যে ‘সীমিত’ রাখায় উৎসাহ নেই অধিকাংশ নিয়োগকর্তার।
কর্মজীবী মানুষকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক বা ভদ্রোচিতভাবে বললে ‘ভালো বেতন’ ঠিক সময়ে দেওয়া হবে কি না, তা যেন আর সর্বজনীন অধিকারের বিষয়ে নেই।
‘কর্মজীবী’ শব্দটি কানে এলেই তো নাকে গন্ধ আসে শ্রমিকের না শুকানো ঘামের। তাঁরা কাজ করেন তৈরি পোশাকশিল্পের জনাকীর্ণ কারখানায় কিংবা অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা খাতে।
জীবন ধারণের উপযোগী বেতনের দাবি নিয়ে কাগজে রিপোর্ট পড়লেও মনে হয় এটা শ্রমজীবী মানুষের দেনাপাওনার আলোচনামাত্র।
১ মে ১৮৮৬ সালে শিকাগোর শ্রমিক আন্দোলন কেন হয়েছিল, গুগল ব্যবহার করেও তার ভালো উত্তর পাওয়া কঠিন।
শ্রমিককল্যাণ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের একটু-আধটু কথা বলতেই হয়, কিন্তু মধ্যবিত্তের চিন্তাধারায় প্রাধান্য পায় আকর্ষণীয় বাবুগিরির চাকরি বা ‘হোয়াইট কলার জব’।
সুতরাং সিভিল সার্ভিস ছাড়া দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠান অথবা নামকরা বহুজাতিক কোম্পানির বড় পদে যোগদান করাটাই কারও কারও জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
আধুনিক বিশ্বে শিক্ষিত মানুষেরা ব্যাপক হারে মুক্তি খুঁজেছেন এই ‘ভদ্রলোকির’ চাকরিতে। সেখানে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিত বলেই ধরে নেন তাঁরা।
গত তিন দশকে আমাদের দেশে ব্যক্তি খাতে এ ধরনের চাকরি বেড়েছেও বেশ। যদিও অনেকে খেয়াল করেননি, তাঁদের জন্য শক্তিশালী আইনি কাঠামো অনুপস্থিত। অবশ্য সারা পৃথিবীতেই সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হোয়াইট কলার জবে মন্দাভাব এসেছে অথবা বেতন–ভাতা কমেছে।
জীবন যাপন ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এই অসহায় কর্মীরা করপোরেট জবের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থেকে চাইলেও বের হতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা আত্মসমর্পণ করছেন বসের খেয়ালখুশি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রলোভনের কাছে।
চাকরি রক্ষার্থে তাঁরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘড়ির কাঁটার পেছন পেছন দৌড়াতে গিয়ে হয়ে পড়ছেন আধুনিক ক্রীতদাস এবং অধীনস্থদের বানাতে চাইছেন জিম্মি শ্রমিক।
তাঁদের কাছেই চাওয়া হচ্ছে আলবার্ট আইনস্টাইনের মানের সৃষ্টি ও গর্দভের মতো আনুগত্য।
তাঁদের মানসিক উচ্চতা জাপানি কায়দায় ছোট রাখা গাছ বনসাইয়ের, আর তাঁদের পৃথিবী এর টবের মতোই। তাঁদের ভাবনা ও কথাবার্তায় প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরাই উপস্থিত থাকেন সারাক্ষণ।
রুটিরুজির বাইরে টাই পরা এই ভদ্রলোকদের কাজের মহান উদ্দেশ্য কী, তা অসংজ্ঞায়িতই থেকে যায়। একদিন সেখান থেকে বিদায় নিলে সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভালো কথাও শোনা যায় না খুব একটা।
চাকরির ক্লান্তি অথবা করপোরেট উচ্চাভিলাষ থেকে কেউ কেউ উদ্যোক্তা হতে চান এবং হয়েছেনও নিকট অতীতে।
এই চাকরিজীবী থেকে উদ্যোক্তায় রূপান্তরিত ব্যক্তি নিয়োগকর্তা হিসেবে আবার প্রমাণ করেন, তিনি তাঁর সাবেক কর্তার শিক্ষায়ই শিক্ষিত।
যেমন প্রতিযোগিতায় সক্ষম বেতন-ভাতা বলতে বোঝেন কম টাকায় লোক খাটানো এবং খরচ কমানোর অর্থ অনেকের চাকরি খাওয়া।
এত দিন যে বসকে তিনি ঘৃণা করতেন, তাঁরই আমিত্ব এখন তিনি লালন করেন সযত্নে। এখানে মানবিক চেহারার বড়ই অভাব।
আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় মুনাফাপ্রেমীদের চাওয়া হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামক জিনিসটি সব ব্যবসায়িক সমস্যা সমাধান করে দিক। মোটাদাগে কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার কিসিমের যন্ত্রে সফটওয়্যারের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের নির্দেশ দিয়ে কার্য সম্পাদন।
এটা হতে পারে কোটি কোটি পণ্য উৎপাদন, হিসাবরক্ষণ, গবেষণার তথ্য পরীক্ষা বা কোনো কিছু রচনা করার ক্ষেত্রে।
তাহলে তাঁদের বিশ্বাস, মানবসম্পদের ঝামেলা কমে যাবে, কারখানায় উৎপাদনশীলতা বাড়বে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে একমুহূর্ত সময় নষ্ট হবে না এবং দ্রুতই অনেক বেশি বিত্তশালী হওয়া যাবে।
প্রযুক্তির দৌরাত্ম্য ও করোনা মহামারির ছোবলে ইতিমধ্যেই ধনীদের হাতে অধিক সম্পদ চলে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
এই ধামাধরা পুঁজিবাদে ধনিক শ্রেণির অতি চালাক কর্মচারীরা মনে করতে পারেন, প্রযুক্তির ব্যবহার তাঁদের সমাজের ওপর অধিক খবরদারি করার সুযোগ দেবে আরও বহুকাল। সে জন্য কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খাতির রাখতে পারলেই হলো!
সমাজে একটি শ্রেণির হাতে প্রায় সব টাকা-পয়সা চলে গেলে তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা কিনবে কারা?
অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চূড়ান্ত সংকটে পড়লে বিশ্বব্যাপী তার কী ভয়াবহ প্রভাব পড়বে, তা আমেরিকারও অনেকেই জানেন ও মানেন।
প্রধানত লোভের ভিত্তিতে ও করপোরেট আধিপত্যে টিকে থাকা এই ব্যবস্থা কোনো কারণে ধসে পড়লে পুঁজিপতিদের পছন্দসই সরকারব্যবস্থা তো আছেই।
২০০৮–এর আর্থিক সংকটে মার্কিন করপোরেশনগুলো সরকারি বেল আউটের সুযোগ নিয়েছে। করের টাকায় করপোরেট সংকট নিরসনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন দায়ী ব্যক্তিরা?
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের উদ্ধারে বা উন্নতিতে ব্যাংকঋণ আছে, যা না দিলেই কে কী করতে পারবে কবে! কর ফাঁকির সংস্কৃতিই–বা মন্দ কী!
এই ধামাধরা পুঁজিবাদে ধনিক শ্রেণির অতি চালাক কর্মচারীরা মনে করতে পারেন, প্রযুক্তির ব্যবহার তাঁদের সমাজের ওপর অধিক খবরদারি করার সুযোগ দেবে আরও বহুকাল।
সে জন্য কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খাতির রাখতে পারলেই হলো!
সমস্যা হলো, এই কৌশলগুলো আজকাল সবারই জানা। পুঁজির পর প্রযুক্তির শাসনে অনেকটা যেন বুদ্ধিহারা চাকরিজীবী সেবকেরা।
অথচ তাঁরা শিক্ষিত নেতা হিসেবে বিবেচিত এবং কায়িক পরিশ্রম করা শ্রমিক নন।
সৃজনশীল মানবিক ধ্যানধারণা দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে শাসন করার কথা তাঁদেরই।
উল্টো উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও চলমান সামাজিক বিন্যাসে তাঁরা নিজেরা কারা, সেটাই বুঝতে পারছেন না।
স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চেতনায় বেড়ে ওঠা কোনো শিক্ষিত মানুষের ছোটলোক ও মেরুদণ্ডহীন হওয়ার কথা ছিল না। এখন যাঁরা নানা খাতে নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা স্বাধীনতা ও অধিকার আন্দোলন সম্পর্কে আরেকটু সচেতন হতেই পারতেন।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—এগুলোই ছিল স্বাধীনতার ইশতেহারের মূল অঙ্গীকার।
ভেবে দেখেছেন, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রীয় চেতনা ভুলে গেলে আপনার নিজের পাওনা আদায় হবে কীভাবে?
তাই আজকের তরুণদের জানা দরকার, কেনা রোবটের মালিকদের প্রত্যাশা হলো, বামনীকৃত মানবসন্তানেরা আজীবন বাস্তবায়ন করে চলবে ‘মনিবদের’ যত ইচ্ছা, তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মুখস্থ বুলি।
এর চেয়েও সরস ‘হাউস’ হচ্ছে, ‘চাই রোবটের আচরণ’, যাতে তাদের একঘেয়ে কর্তৃত্বের ব্যাপারে কখনো যুক্তিতর্ক করবে না জীবন্ত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন চাকরিজীবীরা।
তবে দেকার্তের ‘আমি ভাবি তাই আমি আছি’ ধরনের চিন্তাশীল, সক্রিয় মানুষ ভবিষ্যতে কী ভাববে, কে জানে?
যাঁদের সর্বসাম্প্রতিক ‘গুরু’ বিচিত্র মানবিক প্রতিভা–বিবর্জিত বেকুব মেশিন, তাঁরা প্রতিদিন দেখিয়ে চলেছেন, তাঁরাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাস।
খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক।