শিশু-কিশোরদের দিগন্ত বড় হোক

কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমান
কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমান

ঢাকার বাইরে নরসিংদীর নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসে গিয়েছিলাম আমরা। কিশোর আলোর পক্ষ থেকে। পরীক্ষার ফলের দিক থেকে এটা দেশের অন্যতম সেরা স্কুল। অন্য দিক থেকে কেমন?

আমার সঙ্গে ছিলেন মুনির হাসান। মুনির হাসান প্রশ্ন করলেন, ১৬৪২ সালে একজন বিজ্ঞানী মারা গেলেন। সে বছরই আরেকজন বিজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করলেন। কারা?

অন্তত দশজন চিৎকার করে উঠল, গ্যালিলিও মারা গেছেন আর নিউটন জন্মগ্রহণ করেছেন ১৬৪২ সালে।

মুনির হাসানের পরের প্রশ্ন, এর ঠিক ৩০০ বছর পরে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর জন্ম। ১৯৪২ সালে কে জন্মগ্রহণ করেন?

আবারও কুড়িজন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, স্টিফেন হকিং।

আমরা কিশোর আলোর পক্ষ থেকে পুরস্কার হিসেবে বই আর পত্রিকা নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কার দিতে শুরু করে দিলাম।

আমার প্রশ্ন ছিল, আমেরিকার শিকাগোতে একজন বাঙালি প্রকৌশলী সিয়ারস টাওয়ারের নকশা করেছিলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল সেটা। এই প্রকৌশলীর নাম কী?

পাঁচজন বলে উঠল, এফ আর খান।

প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল রাজধানীর বিয়াম মডেল স্কুলে। শিক্ষার্থীরা খুবই চটপটে। যা জিজ্ঞেস করি, তারই জবাব দিতে জানে।

কিন্তু আরেকটা স্কুলে গিয়ে বেশ হতাশ হতে হলো। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নাম শুনেছ?

এক শ জনে একটা মাত্র হাত উঠল।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নাম শুনেছ?

এক শ জনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন হাত তুলল।

হয়তো জানে শিক্ষার্থীরা, হঠাৎ বুঝতে পারছিল না, হাত তুলবে কি তুলবে না।

আমাকে উচ্চমাধ্যমিক কলেজের এক শিক্ষক গতকাল ফোন করেছিলেন। ভাই, আপনারা কি একটা গোলটেবিল বৈঠক করতে পারেন। বিষয় হবে, শিশু-কিশোরেরা ক্লাসে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের সবার চোখ ঢুলু ঢুলু। তারা সারা রাত মোবাইলে তাকিয়ে থাকে, সারা দিন ঝিমায়। এই সমস্যার সমাধান কী?

আমরা কিশোর আলো শুরু করেছিলাম আজ থেকে ১০ বছর আগে—২০১৩ সালে। আমাদের লক্ষ্য ছিল: ১. শৈশব-কৈশোরকে আনন্দপূর্ণ করে তোলা। ২. শিশু-কিশোরদের দিগন্তকে বাড়িয়ে দেওয়া। তাদের কল্পনা আর সৃজনশীলতাকে অবাধ করে তোলা। ৩. তাদের মধ্যকার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তোলা। তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করা। ৪. তাদের স্বপ্নের মতো বড় হতে উদ্বুদ্ধ করা। ৫. তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ, সামাজিকতা, নৈতিকতা, সাংগঠনিক প্রতিভার বিকাশ ঘটানো। সৃজনশীল ভালো কাজে তাদের অনুপ্রাণিত করা।

এ জন্য আমরা জোর দিই মজার মজার গল্প-কবিতা-কমিকস-ধাঁধার ওপরে। পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান-জীবনাচার নিয়ে থাকে নানা ধরনের ফিচার। কিশোরেরা নিজেরাও লেখে। নিজেরাও আঁকে।

শিশু-কিশোরদের চলার পথে নানা সমস্যা আসে। সেসব সে কাকে বলবে? আমরা সেসব নিয়ে আলোচনা করি। বন্ধুর মতো পরামর্শ দিই। বিশেষজ্ঞরাও পরামর্শ দেন। আবার পরীক্ষায় ভালো করার উপায় নিয়েও আমরা আলোচনা করি, মোবাইল ফোন বা স্ক্রিনের সামনে কতক্ষণ থাকব, তা নিয়েও কথা হয়। আর আমরা বলি বই পড়তে। বলি, কাগজের বই হাতে নিয়ে পড়ো। সেই নেশাটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা মজার মজার উপন্যাস ছাপি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, রকিব হাসান, আহসান হাবীব থেকে শিশু-কিশোরদের প্রিয় লেখকদের গল্প-উপন্যাস অনেক ছাপা হয়েছে ১০ বছরের কিশোর আলোয়। যেমন ছাপা হয়েছে অমর্ত্য সেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ থেকে শুরু করে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার। মজার ব্যাপার হলো, এই সাক্ষাৎকারগুলো নিয়েছে শিশু-কিশোরেরা।

কিশোর আলোর আছে বুক ক্লাব। শিশু-কিশোরেরাই সেসব পরিচালনা করে। তারা বই পড়ে, বই নিয়ে আলোচনা করে। ফটোগ্রাফি করে। ভিডিও বানায়।

শুধু জিপিএ–৫ দিয়ে হয় না। আজকের যুগে ভালো ছাত্র হওয়া কিংবা পরীক্ষার ফল ভালো করার দরকার আছে। ভালো বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক, গবেষক হতে হলে পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তবে শুধু ভালো ফল দিয়ে সফল মানুষ তৈরি হয় না, সমাজের জন্য উপকারী মানুষ গড়ে ওঠে না। এ জন্য বইপড়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে অংশ নেওয়া, বড় স্বপ্ন দেখা, নিজেকে উপস্থাপন করতে শেখা, খেলাধুলা ইত্যাদির চর্চার দরকার পড়ে।

আমরা ভালো মানুষ চাই। সুন্দর মানুষ চাই। আমাদের কৃষক-শ্রমিকেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে। আর তথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলো ব্যাংক লুট করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে, দেশের টাকা বাইরে পাচার করছে। আমাদের দরকার মূল্যবোধসম্পন্ন ভালো মানুষ। দেশপ্রেমিক মানুষ। নীতিমান মানুষ।

আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে মোম আছে, সলতে আছে। শুধু একটুখানি অগ্নিসংযোগের অপেক্ষা। সলতেটা হয়তো একটু উসকে দিতে হবে।

একটা প্রদীপ জ্বললে লাখো প্রদীপ জ্বলে উঠবে। কিশোর আলোয় আমরা তা-ই চাই। কিশোর আলো পত্রিকাটা প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ৫-৬ তারিখে প্রকাশিত হয়। কিন্তু কিশোর আলা ডটকম রোজ নতুন লেখা ও ছবি প্রকাশ করে। আপনার শিশু-কিশোরকে সেই খোঁজটা দিন। আপনি আপনার সন্তানের ভালোর জন্য কত-কী করছেন। তাকে কোচিং সেন্টারে নিয়ে গিয়ে বাইরে বসে থাকছেন, স্কুলে দিয়ে গরমের মধ্যে স্কুলের গেটে অপেক্ষা করছেন। আপনার এই নিবেদনের কোনো তুলনা হয় না। পাশাপাশি ওর হাতে একটা কিশোর আলো তুলে দিন।

আমাদের শিশু-কিশোরেরা অনেক চৌকস। অনেকগুলো স্কুলে গিয়ে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। তবে সার্বিকভাবে শিক্ষার মানের অবনমন ঘটছে। এটাও আমাদের দুর্ভাবনায় ফেলে। বিজ্ঞান নিয়ে মাধ্যমিক পাস করবে, কিন্তু নিউটনের তিনটা সূত্র বলতে পারবে না—এই রকমটা যখন দেখি, মন খারাপ করি। আর ক্লাস সেভেন-এইটের ছেলেরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নামই শোনেনি, ঢাকার স্কুলে এ রকম ঘটতে দেখলে মন খারাপ হয়। আর আছে জিপিএ–৫–এর যন্ত্রণা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাটাও বারবার স্মরণ করি, পুস্তক দুই প্রকার—পাঠ্যপুস্তক আর অপাঠ্যপুস্তক। কর্তৃপক্ষ বা টেক্সটবুক বোর্ড যেসব বই আমাদের সাব্যস্ত করে দেয় পড়তে হবে বলে, সেসব হলো অপাঠ্যপুস্তক। আর বাকি সব বই-ই পাঠ্যপুস্তক।

নবীন ছাত্র ঝুঁকে আছে একজামিনের পড়ায়

মনটা কিন্তু কোথা থেকে কোন্ দিকে যে গড়ায়,

অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব সামনে আছে খোলা,

কর্তৃজনের ভয়ে কাব্য কুলুঙ্গিতে তোলা।

আমরা শিশু-কিশোরদের আনন্দের মাধ্যমে পড়ার খোঁজ দিতে চাই।

আপনাদের পরামর্শও আমরা চাই। সহযোগিতা চাই। তা আমরা অবশ্যই পাচ্ছি। সে কারণেই কিশোর আলো বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত ম্যাগাজিন।

কিশোর আলোর ১০ নম্বর জন্মবার্ষিকীতে আপনি আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন।

আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক