১৯৭৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসির ওভাল অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সদ্য নিয়োগ পাওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার
১৯৭৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসির ওভাল অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে সদ্য নিয়োগ 
পাওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার

কিসিঞ্জার যে মানুষগুলোকে মানুষই মনে করতেন না

১০০ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত হেনরি কিসিঞ্জার ইতিহাসে নিজের নামটি উজ্জ্বলভাবে লিখে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

নিজের লেখা স্মৃতিকথা এবং বইয়ের মাধ্যমে; গণমাধ্যম ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিঘনিষ্ঠ অভিজাত গোষ্ঠীকে ‘হাত করে’ এবং হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বৈচিত্র্যময় রাজনীতিবিদদের প্রশংসা কুড়িয়ে রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের এই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিজের খ্যাতিকে ঘষেমেজে সব সময় চকচকে রাখার চেষ্টা করে গেছেন।

বৈশ্বিক বিষয়াবলি নিয়ে কিসিঞ্জারের অন্তর্দৃষ্টি এবং চীনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান প্রশংসনীয়। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর গৃহীত নীতিগুলো শেষ পর্যন্ত নির্মমতার জন্য কুখ্যাত হয়ে থাকবে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, বাংলাদেশ, চিলি, আর্জেন্টিনা, পূর্ব তিমুর, সাইপ্রাস এবং অন্য আরও দেশ সংশ্লিষ্ট তাঁর পুরো রেকর্ড বিবেচনায় নিলে তাঁর প্রশংসাকারীর তালিকায় কতজনই–বা থাকবে?

হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের সব যুক্তি খারিজ করে দিয়ে কিসিঞ্জার গোপনে কম্বোডিয়ায় মার্কিন স্থল অভিযান অনুমোদন করেছিলেন। তাঁর সম্মতিতেই ১৯৭০ সালের মে মাসে এই অভিযান শুরু হয়েছিল।

এরপর কিসিঞ্জার যুক্তি দিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বুঝিয়েছিলেন, কম্বোডিয়ায় যে মাত্রায় বোমা ফেলা হচ্ছে, তা পর্যাপ্ত নয়। তিনি সেখানে আরও ভারী ও বেশি সংখ্যক বোমা ফেলার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। তাঁর কথাতেই নিক্সন ‘কম্বোডিয়ায় ব্যাপক বোমা হামলা চালানোর’ অনুমতি দেন এবং ডিসেম্বরে ব্যাপক মাত্রায় সেখানে বোমাবর্ষণ শুরু হয়।

সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর পার্থক্যকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে কিসিঞ্জার তখন সেনাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের সামনে যা কিছু উড়বে অথবা নড়াচড়া করবে, সেটিই হবে তোমাদের নিশানা।’

১৯৭৫ সালের নভেম্বরে মাওবাদী খেমারুজ গোষ্ঠী কম্বোডিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করার পর তারা ব্যাপকভাবে সাধারণ নাগরিকদের নিধন শুরু করে। ওই সময় কিসিঞ্জার থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছিলেন, তিনি (থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী) যেন কম্বোডিয়ার লোকদের জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্র খেমারুজ নেতাদের পাশে আছে। সে সময় তিনি কম্বোডিয়ার সাধারণ মানুষকে ‘খুনি ঠগ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

পাকিস্তান সংকটের পুরোটা সময়জুড়ে কিসিঞ্জার ভারতীয়দের মানুষ হিসেবে তিরস্কার করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই তারা (ভারতীয়রা) উদ্বাস্তুদের উসকানি দিয়েছে।’ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দমনাভিযান চালানোর জন্য তিনি ভারতীয়দের দায়ী করেছেন। তিনি ভারতীয়দের বিষয়ে অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন, ‘তারা ঝাড়ুদার শ্রেণির লোক’।

সোভিয়েত ইউনিয়নে ইহুদিদের ওপর উৎপীড়নের বিষয়েও তাঁকে নির্দয় অবস্থানে দেখা গিয়েছিল। তিনি ওই সময় ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্যাস চেম্বারে যদি ইহুদিদের রাখা হয়, সেটিকে মার্কিন উদ্বেগের বিষয় মনে করা ঠিক হবে না। সেটিকে বড়জোর মানবিক উৎকণ্ঠার বিষয় হিসেবে ধরা যেতে পারে।’

কিসিঞ্জারের আসল চরিত্র সবচেয়ে বেশি উন্মোচিত হয়েছিল সম্ভবত ১৯৭১ সালে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (যেটি এখন বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। এই দেশ স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ক্লায়েন্ট দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল) ধারাবাহিকভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা ও উৎপীড়ন চালিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক। সেই নৃশংসতম ঘটনার তথ্য–উপাত্ত কিসিঞ্জার চাপা দিতে চেয়েছিলেন।

হোয়াইট হাউসের ওই সময়কার সবচেয়ে সংবেদনশীল নথিপত্রের কিছু অংশ কয়েক দশক ধরে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে গোপন রাখা হয়েছে। তবে আমি আমার নিজের গবেষণায় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের ১০ বছর ঝগড়ার গোপন নথিপত্রের কিছু কিছু বের করতে পেরেছি।

মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার ভিত্তিতে সাবেক ভারতবর্ষ ভেঙে যে পাকিস্তানের জন্ম দেওয়া হয়েছিল, সেটি আদতে দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে মূলত বাঙালিদের বাস ছিল। এখানকার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এক হাজার মাইল দূর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি অভিজাত শাসকেরাই শাসন করতেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা জয়লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে সংকটের শুরু হয়।

সাংবিধানিক সমঝোতার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের জান্তা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এক রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তারা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।

কিসিঞ্জারের নিজেরই হোয়াইট হাউস স্টাফ তাঁকে বলেছিলেন, শুরু থেকেই এটি একটি ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’। ওই বছরের জুন নাগাদ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানে কমপক্ষে দুই লাখ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে; সিআইএর সেপ্টেম্বর মাসের গোপন প্রতিবেদনেও একই নিহত মানুষের সংখ্যা প্রায় সে রকমই ছিল। ওই বছর প্রাণভয়ে প্রায় এক কোটি বাঙালি পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন নিয়ে বাঙালি গেরিলারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের ওপর আক্রমণ করে বসে।

এরপর তীব্র কিন্তু সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানের অপমানজনক পরাজয় এবং একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তানের এই পরাজয় ছিল মূলত স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিপর্যয়কর পরাজয়।

নিক্সন প্রশাসন ভালো করেই জানত পাকিস্তানের ওপর একচেটিয়া খবরদারি না থাকলেও দেশটির ওপর তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। ওই সময় পাকিস্তানের ভারতভীতি ছিল; কারণ ভারত সে সময় নিজেকে জোটনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ বলে ঘোষণা করলেও তাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের জোরালো গাঁটছড়া ছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালানোর কয়েক সপ্তাহ আগেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সে সময় কিসিঞ্জার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ওই সময় তিনি পাকিস্তানি জেনারেলদের নিজ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানো থেকে বিরত থাকতে বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানকে সংযম দেখানোর কোনো পরামর্শই দেননি। গৃহযুদ্ধ এড়াতে পশ্চিম পাকিস্তানকে সাধারণ নির্বাচনের ফল মেনে নিতে কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগির সমঝোতা করতেও চাপ দেননি।

তিনি তাদের নৃশংসতা থেকে বিরত রাখার জন্য কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করেননি। তারা যাতে নৃশংসতা না চালাতে পারে, সে জন্য আমেরিকান সমর্থন হারানোর ভয়ভীতিও তিনি দেখাননি কিংবা হুমকিও দেননি।

বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী শক্তির বিষয়ে কিসিঞ্জার তাঁর নিজের গোয়েন্দাদের কথায় আমল না দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। পাকিস্তানিদের কথায় তিনি বিশ্বাস করছিলেন, বাঙালি কাপুরুষ, তাদের সহজেই বন্দুকের মুখে দমিয়ে রাখা যাবে।

একটি নথি অনুযায়ী, কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা, বাঙালিরা মোটেও ভালো যোদ্ধা না।’

পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের সংখ্যা উল্লেখ করে কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলেছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে শক্তির ব্যবহার ফলপ্রসূ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি লোককে ৩০ হাজার সেনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ঠিক আছে, এ কথা এখনো সত্য হতে পারে, তবে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি শান্ত আছে।’

পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস অভিযান চালিয়েছিল। ভারতে নিযুক্ত ওই সময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং (যিনি পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্ক থেকে রিপাবলিকান সিনেটর হয়েছিলেন) কিসিঞ্জারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘পরিষ্কারভাবে হিন্দুদের ওপর গণহত্যা চালানো হচ্ছে।’

হোয়াইট হাউসের টেপে এ সময় কিসিঞ্জারকে ‘মরণাপন্ন বাঙালিদের’ জন্য ‘সহানুভূতি দেখানো’ মার্কিন নাগরিকদের তিরস্কার করতে শোনা গেছে।

পাকিস্তান সংকটের পুরোটা সময়জুড়ে কিসিঞ্জার ভারতীয়দের মানুষ হিসেবে তিরস্কার করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই তারা (ভারতীয়রা) উদ্বাস্তুদের উসকানি দিয়েছে।’ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দমনাভিযান চালানোর জন্য তিনি ভারতীয়দের দায়ী করেছেন। তিনি ভারতীয়দের বিষয়ে অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন, ‘তারা ঝাড়ুদার শ্রেণির লোক’।

১৭ জুন ভারতীয়দের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলেছিলেন, ‘তারা সাংঘাতিক চাটুকার, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। তারা তোষামোদ করতে ওস্তাদ। তারা সূক্ষ্ম চাটুকারিতায় ওস্তাদ। এভাবেই তারা ৬০০ বছর টিকে আছে।’

দায়িত্ব পালনের পুরোটা সময় কিসিঞ্জার ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে অসম্মানসূচক কথাবার্তা বলেছেন। ইন্দিরাকে অসংখ্যবার তিনি ‘দুশ্চরিত্রা’ এবং ভারতীয়দের ‘জারজ’ বলে গালি দিয়েছেন।

অদ্ভুত বিষয় হলো, জীবনের শেষবেলাতে এসেও এসব নিয়ে কিসিঞ্জারের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি।

  • গ্যারি জে বাস প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড বইয়ের লেখক

  • দ্য আটলান্টিক ডট কম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ