মোবাইল অপারেটরদের প্যাকেজ-বাণিজ্য এবং স্বপ্নের বাড়ি যাওয়া

স্বপ্ন বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর মা কি পারবে সঠিক প্যাকেজটি বেছে নিতে?
ছবি: প্রথম আলো

ইশপের সেই গল্পের কথা মনে আছে নিশ্চয়! শিয়াল ও বিড়াল জঙ্গলে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। বিপদে পড়লে পালানোর জন্য যে ডজন ডজন উপায় জানা আছে, সেটি নিয়ে গর্ব করছিল শিয়াল। বেচারা বিড়াল মন খারাপ করে জানাল, পালানোর একটি উপায়ই শুধু জানা আছে তার।

গল্পের মাঝখানেই এসে হানা দেয় শিকারি। তখন বিড়াল একলাফে উঠে যায় গাছের মগডালে। পালানোর একমাত্র উপায়টিই তার জানা। ওদিকে অনেক উপায় জানা শিয়াল ঠিক কোন উপায়ে পালাবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই ধরা পড়ে শিকারির কাছে। গল্পের নীতিকথা হলো, অনেকগুলো উপায় থাকার চেয়ে নির্ভরযোগ্য একটি উপায় থাকাই শ্রেয়।

অনেকগুলো উপায় বা পছন্দের সুযোগ একধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। এটিকে প্যারালাইসিস বাই অ্যানালাইসিস (অধিক বিশ্লেষণে অসহায়) বলা হয়ে থাকে, যেখানে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ বা চিন্তাভাবনা সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়াকে ‘প্যারালাইজড’ করে দেয়। অর্থাৎ, সঠিক সময়ে সমাধান বা পদক্ষেপ নেওয়াকে ব্যাহত করে। এটিই হয়েছিল ইশপের গল্পের শিয়ালের।

বাস্তবেও দেখা যায়, অনেকগুলো টিভি চ্যানেল থাকলে রিমোট হাতে নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো চ্যানেলে না থেকে এ চ্যানেল-ও চ্যানেলে ঘোরাঘুরি করেন দর্শক। পরবর্তী সময় ক্লান্ত হয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি চ্যানেলে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বড় লিস্ট দেখে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে অনেকেই তড়িঘড়ি করে কিছু একটা অর্ডার দিয়ে ফেলেন। অস্পষ্ট ধারণার ওপর ভিত্তি করে, তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার এ আত্মঘাতী প্রক্রিয়াকে বলা হয় এক্সটিঙ্কট বাই ইনস্টিঙ্কট বা প্রবৃত্তি দ্বারা বিলুপ্তি।

আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো ইশপের গল্পের শিয়ালকেও ছাড়িয়ে গেছে। যে সংখ্যক প্যাকেজ তারা দিয়ে রেখেছে, সেখান থেকে উপযুক্ত প্যাকেজ বেছে নেওয়া খুব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব হবে। একটি অপারেটরের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, তাদের শুধু ইন্টারনেট প্যাকেজই আছে পঞ্চাশের কাছাকাছি। অন্য আরেকটিতে আছে ষাটটির মতো প্যাকেজ। ডেটা, মিনিট, বার্তা মিলিয়ে আছে প্যাকেজের আরও হরেক রকমের বিন্যাস-সমাবেশ। টফি প্যাকেজ, ইমো প্যাকেজ, বায়োস্কোপ প্যাকেজ, দিনের প্যাকেজ, রাতের প্যাকেজ, আমার প্যাকেজ, রেগুলার প্যাকেজ, সপ্তাহের প্যাকেজ, মাসের প্যাকেজ, বোনাস প্যাকেজ, আরও কত যে রং-বেরঙের প্যাকেজ!

খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিন দিনের প্যাকেজে কম দামে অনেক বেশি ডেটা দিয়ে রাখা হয়েছে। এর কারণ কী? সম্ভাব্যতার হিসাব করলে, এ কম সময়ে এত বেশি ডেটা ব্যবহারকারী হয়তো খরচ করতে পারবে না? অন্যদিকে, মাসের প্যাকেজে সামান্য ডেটারই তুলনামূলক দাম অনেক বেশি। বিখ্যাত সেই ‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহয়্যার, নর অ্যানি ড্রপ টু ড্রিংক’ লাইনের মতো এখানেও অবস্থা হয়েছে ‘প্যাকেজ প্যাকেজ এভরিহয়্যার, নর অ্যানি প্যাকেজ টু চুজ’। সারমর্ম হলো, এত এত প্যাকেজের মধ্যেও পছন্দ হওয়ার মতো প্যাকেজ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

আমাদের জীবনযাপনের মান বাড়ানোতে মোবাইল অপারেটরগুলোর অবদান আছে। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে টেলিযোগাযোগব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু যে সংখ্যক প্যাকেজের অফার তৈরি করা হয়েছে, সেই অফার থেকে সঠিক অফার নির্বাচন করা প্রান্তিক অঞ্চলের স্বল্পশিক্ষিত একজন মানুষের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব? স্বপ্নরা বাড়ি যাবে, মায়ের কাছে যাবে, স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

তারপরও এক্সটিঙ্কট বাই ইনস্টিঙ্কট পদ্ধতিতে কোনো না কোনো একটা প্যাকেজে থিতু হলে কিছুদিন পর হয়তো দেখা যাবে সেই প্যাকেজ নেই। দাম বাড়ানো হয়েছে বা ডেটা কমানো হয়েছে। কী পদ্ধতিতে এ দাম নির্ধারণ করা হয়? সরকারের এক দেশ এক রেট নির্ধারণের পর আইএসপিগুলোকে পাঁচ শ টাকায় ইন্টারনেট সেবা প্রদান করতে হয়। ওয়্যারলেস রাউটার ব্যবহারের মাধ্যমে সে ইন্টারনেট অনেকের সঙ্গে শেয়ার করা যায়। গড়ে একটি লাইন পাঁচজন ব্যবহার করলে প্রতিজনে মূল্য পরিশোধ করতে হয় এক শ টাকা। সেখানে মাসব্যাপী কাজ চালানোর মতো একটা মোবাইল প্যাকেজ ক্রয় করলেও এর প্রায় তিন-চার গুণ বেশি দাম দিতে হচ্ছে, সঙ্গে ডেটার সীমা তো থাকছেই।

চাইলেই কি দাম বাড়িয়ে প্যাকেজের দাম নির্ধারণ করে ফেলা যায়? বাড়তি দামের যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি গ্রাহকদের জানানোর প্রয়োজন নেই? কেব্‌ল.কো.ইউকে-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গড় দাম দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশি। সবচেয়ে সস্তা প্যাকেজের দামও সব কটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা প্যাকেজের মূল্য রিপোর্ট করা হয়েছে ৫.৬২ ডলার, যেখানে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে প্যাকেজের মূল্য যথাক্রমে ৪.৮৭, ৪.৭২, ১.৮৫ ও ১.৪৫ ডলার।

তালিকার প্যাকেজ ছাড়াও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানসিক চাপে ফেলার জন্য আরও যুক্ত হয়, যখন-তখন পাঠানো বিভিন্ন প্যাকেজ অফারের বিজ্ঞাপন বার্তা। সঙ্গে নোটিফিকেশন বার্তা তো আছেই। যেগুলোর বেশ কিছু আবার যৌক্তিকতার মানদণ্ডে প্রশ্নসাপেক্ষ। যেমন একটি অপারেটর কল ড্রপ হওয়ার পর ৩০ সেকেন্ড কল টাইম দিয়ে বার্তা পাঠায় ‘অ্যাজ উই কেয়ার’ (যেহেতু আমরা গুরুত্ব দিই)। কল ড্রপ হওয়ার অর্থই হচ্ছে টেকনিক্যাল কারণে প্রতিশ্রুত সার্ভিস দিতে ব্যর্থ হওয়া। সে ক্ষেত্রে ৩০ সেকেন্ড দেওয়া কি আসলে কেয়ার করা? নাকি ক্ষতিপূরণ দেওয়া?

আমাদের জীবনযাপনের মান বাড়ানোতে মোবাইল অপারেটরগুলোর অবদান আছে। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে টেলিযোগাযোগব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু যে সংখ্যক প্যাকেজের অফার তৈরি করা হয়েছে, সেই অফার থেকে সঠিক অফার নির্বাচন করা প্রান্তিক অঞ্চলের স্বল্পশিক্ষিত একজন মানুষের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব? স্বপ্নরা বাড়ি যাবে, মায়ের কাছে যাবে, স্বপ্ন যাবে বাড়ি।

কিন্তু বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর, মা কি পারবে এত বড় তালিকা থেকে সঠিক প্যাকেজটি বেছে নিতে? সহনীয় দামে মাসব্যাপী স্বপ্নের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ কি পাবে মা? নাকি তিন দিনের প্যাকেজ কিনে সারা মাস মলিন বদনে মুঠোফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখবে, ‘আপনার ইন্টারেনেট প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে?’

  • ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

    bmmainul@du.ac.bd