২০১৮ সালে আসিয়ান সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভিন্ন এবং এ ক্ষেত্রে তারা উভয়েই সফল। অস্ট্রেলিয়াকে কোনো পক্ষ বাছাই করতে হয়নি এবং আমরা কখনো পক্ষ বেছে নেবও না।’
কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতে অস্ট্রেলিয়া নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটে ভিড়ে যায়।
ওই একই সম্মেলনে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং পক্ষ বরং পক্ষ বাছাইয়ে বাধ্য হওয়া লাগতে পারে—এমন বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, কোনো পক্ষে না যাওয়াটা আমাদের জন্য খুবই কাম্য একটি বিষয় হতে পারে। কিন্তু এমন পরিস্থিতি আসতে পারে, যাতে করে আসিয়ান দেশগুলোকে যেকোনো এক পক্ষকে বেছে নিতে হতে পারে। আমি আশা করি, সে রকম দিন খুব তাড়াতাড়ি আসবে না।’
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরও বেশি তীব্র হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে, সব কটিতেই অস্ট্রেলিয়া ওয়াশিংটনের পক্ষ নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এ ধরনের নজির নেই।
আসিয়ানের দেশগুলোকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষই কাছে টানছে এবং সম্ভবত জোর করে তাদের পক্ষভুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেননা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার মতো বিপজ্জনক পথে যেতে চায় না। বিশ্বের দুই বড় শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাঝে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কোন অবস্থান নেয়, সেটাই এখনকার শিক্ষণীয় বিষয়।
‘দ্য অ্যানাটমি অব চয়েস: সাউথইস্ট এশিয়া বিটুইন দ্য সুপারপাওয়ার’ শিরোনামে একটি সমীক্ষায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসিয়ানের দেশগুলোর পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রবণতাকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাথমিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে লাওস, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার খুব শক্তভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
এই পাঁচ দেশ সম্ভবত কোনো একদিকে তাদের ঝুঁকে পড়ার এই অবস্থানকে ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করছে না। ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সুযোগ, সামরিক কেনাকাটার ইতিহাস থেকে এই ঝুঁকে পড়া স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এই পক্ষপাতিত্ব তাদের স্বার্থও বেশ ভালোভাবে রক্ষা করে।
অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে জনমতের ওঠানামা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কতটা প্রভাব ফেলে? যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে বেশ সরস একটা মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘আসিয়ানের দেশগুলোকে পক্ষ নেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের বলা উচিত নয়। এই দেশগুলোকে যদি পক্ষ নেওয়ার কথা তোমরা বলো, তাহলে যে ফলাফল আসবে, সেটা তোমাদের পছন্দ না–ও হতে পারে।’
কিন্তু বড় শক্তির প্রতিযোগিতায় নিরাপদ দূরত্বে থাকা দেশের ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত হলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ব্রুনেই ও থাইল্যান্ড। এ দেশগুলো যদি কোনো একটা পক্ষে চলে যায়, তাহলে বলতে হবে সেটা প্ররোচনামূলক ঘটনা হবে।
একটা বিষয় হলো, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বর্তমান অবস্থানকে স্থায়ী বা টেকসই বলে ধারণা করা ভুল হবে। গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস-ইউসুফ অ্যাইজাক ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের অভিজাত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা কীভাবে ওঠানামা করে।
২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিক্ষিত অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব কিছুটা বেড়েছে। আগের বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জনমত যেখানে ৫৭ শতাংশ ছিল, এ বছর সেখানে তা বেড়ে ৬১ শতাংশ হয়েছে।
দেশভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বেশ মজার ফলাফল পাওয়া যায়। কম্বোডিয়া ও লাওসে অভিজাতদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন বিপুল পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমার, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অভিজাতদের সমর্থন চীনের দিকে বেড়েছে।
অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে জনমতের ওঠানামা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কতটা প্রভাব ফেলে? যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে বেশ সরস একটা মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘আসিয়ানের দেশগুলোকে পক্ষ নেওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের বলা উচিত নয়। এই দেশগুলোকে যদি পক্ষ নেওয়ার কথা তোমরা বলো, তাহলে যে ফলাফল আসবে, সেটা তোমাদের পছন্দ না–ও হতে পারে।’
আসিয়ানের দেশগুলোর পক্ষ বেছে নেওয়া পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে চীন তাতে জিতে যাবে। যদি স্থল ভূগোলের কথা বিবেচনা করা যায়, তাহলে চীনের সঙ্গে খাপ খেয়ে চলা দরকার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার। আর সমুদ্র ভূগোলের কথা ধরা হলে যুক্তরাষ্ট্রকে দরকার তাদের।
এই দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনুরাগ থাকার কথা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ সমীক্ষায় বলছে, সাধারণ মানুষের অনুরাগ চীনের প্রতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপত্তি সাধারণ মানুষের আরেকটি বিবেচ্য বিষয়।
ঠান্ডাযুদ্ধের কালে মতাদর্শিক কুটুম্বিতার আলোকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমের মধ্যে পক্ষ বেছে নিয়েছিল। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলোর সীমানায় সমুদ্র আছে, সেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমকে বেছে নিয়েছিল। আর মূল ভূমির দেশগুলো চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ নিয়েছিল।
কিন্তু আজকের দিনে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া দুই পক্ষের সঙ্গেই থাকার নীতি নিয়েছে। আসিয়ান দেশগুলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগগুলোর মধ্যে যেগুলো তাদের জন্য উপযুক্ত, সেগুলোতে যুক্ত হচ্ছে।
চীনের উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং দ্য রিজওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ। এ ছাড়া চীনের প্রস্তাবিত উদ্যোগ হলো গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট, গ্লোবাল সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল সিভিলাইজেশন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগগুলোর মধ্যে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ, ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফেমওয়ার্ক।
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যদি দুই পক্ষের সঙ্গে ভাগাভাগি করে অংশ নেওয়ার নীতি নেয়, তাহলে চীনের উদ্যোগগুলো যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগগুলোর চেয়ে বিস্তৃত ও টেকসই সুযোগ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে দিন দিন চ্যালেঞ্জগুলো বড় হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এ অঞ্চলে তাদের পুরোপুরি ভিন্নভাবে আসতে হবে।
ইউএন ফং খং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত