আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি
আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি

মতামত

সিসি কি মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে মিটমাটে যাচ্ছেন

মিসরের সরকার ৭১৬ জনকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে এবং প্রশ্ন উঠেছে। এই তালিকায় মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে কি প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসন এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের সমাধান খোঁজা হচ্ছে?

মিসরের সন্ত্রাসী তালিকায় মোট ৪ হাজার ৪০৮ ব্যক্তি ও সংগঠনের নাম ছিল। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার ৭০০, যার অধিকাংশই ইসলামপন্থী এবং ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধী। সন্ত্রাসী তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, নজরদারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, সরকারি চাকরি বা পদে থাকার যোগ্যতা হারানো, কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা এবং দেশ-বিদেশে তহবিল সংগ্রহে বাধা দেওয়ার মতো বিভিন্ন শাস্তি ছিল। 

তালিকা থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেমন সংগঠনটির সাবেক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্পর্ক কমিশনার ইউসুফ নাদা, প্রচারক ওয়াগদি ঘোনেইম, সাবেক মন্ত্রী ইয়াহিয়া হামেদ এবং সংগঠনটির মুখপাত্র জিহাদ এল-হাদ্দাদ। এ ছাড়া মানবাধিকারকর্মী হাইসাম আবু খলিল, আবদেল ওয়াহিদ আশুর এবং আলিয়া নাসর এল-দিনের নামও তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। 

এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেকে। বিশেষত আল-আজহার আল-শরিফ, যেটি সমাজে সংহতি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেয়, তারাও এই উদ্যোগকে ভালোভাবে দেখছে। সংবাদপত্রগুলোতেও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট আল-সিসি তাঁর জনগণের প্রতি সদিচ্ছা প্রকাশ করে নতুন এক অধ্যায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে মিসরের বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আমর আদিব এবং আহমেদ মুসা এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সমঝোতা করা উচিত হবে না। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, মিসরের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার আগে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করার প্রচেষ্টা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করেছে। তার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে। 

বর্তমান বাস্তবতা হলো ব্রাদারহুডের নেতারা কারাগারে থাকায় তাঁদের জনগণের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা নেই। সরকারের ওপর কার্যকরভাবে চাপ দেওয়া যাবে—এমন কোনো অস্ত্রও তাদের হাতে নেই। তবে মিসরের তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপটে মিসরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে। 

কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করার প্রচেষ্টা হতে পারে, যা সরকার এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে সাময়িক সমঝোতার পথ খুলে দিতে পারে। আর অন্যরা বিশ্বাস করেন, এটি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় মিত্রদের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হতে পারে, যা মিসরের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। 

ব্রাদারহুডের সদস্যরা শর্ত সাপেক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমা পেতে পারেন—এমন একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে কি না, এখন সেই প্রশ্ন উঠছে। ধারণা করা যেতে পারে, রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে পুরোপুরি অবসর নেওয়া এবং ধাপে ধাপে জেলে থাকা সদস্যদের মুক্তি দেওয়ার শর্তে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের ছাড়া হতে পারে। তবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর আপত্তি এবং উপসাগরীয় মিত্রদের বিরোধিতার কারণে সে ধরনের চুক্তি করা জটিল হতে পারে। 

বর্তমান বাস্তবতা হলো ব্রাদারহুডের নেতারা কারাগারে থাকায় তাঁদের জনগণের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা নেই। সরকারের ওপর কার্যকরভাবে চাপ দেওয়া যাবে—এমন কোনো অস্ত্রও তাদের হাতে নেই। তবে মিসরের তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপটে মিসরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামদি আল-মাসরি বলেছেন, এই পদক্ষেপ বিচারিক এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার মাধ্যমে বিরোধীদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। 

মিসরের সংবাদপত্রগুলোতে সম্প্রতি একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে। এটি প্রেসিডেন্ট আল-সিসির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে তিনি তার বিরোধীদের প্রথমবারের মতো ‘দুষ্ট লোক’ না বলে ‘আমার জনগণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে সরকারের অতীতের পাতা ওলটানোর, নিরাপত্তা তদন্ত বন্ধ করার এবং আটক বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। 

এখন আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে, যা মিসরে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাজনৈতিক বিভাজন দূর করতে পারে। এই পরিস্থিতি মুসলিম ব্রাদারহুড ও আল-সিসির ক্ষমতার রশি টানাটানির পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে। এখন এর অবসান হওয়া দরকার। 

মাহমুদ হাসান মিসরের লেখক ও সাংবাদিক

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ