মাহিয়া মাহিরা যে কারণে এমপি হতে চান?

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান মাহিয়া মাহি। তাঁর গণসংযোগ ও পথসভায় ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ।
ছবি : সংগৃহীত

বছর শেষে শীত জেঁকে নামতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও গত কয়েক মাসের উত্তাপ কাকতালীয়ভাবেই যেন কিছুটা থিতিয়ে এসেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বিএনপি ২৭ দফা আর আওয়ামী লীগ স্মার্ট বাংলাদেশের কর্মসূচি দিয়েছে। ৯টি বিভাগীয় সম্মেলন শেষে ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে আচমকাই বিএনপির ছয়জন সংসদ সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরদিনই তাঁরা স্পিকারের কাছে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ জমা দেওয়ায় তাঁদের আসন শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

নতুন বছরে ১ ফেব্রুয়ারি ছয়টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ৮-৯ মাস মেয়াদকালের জন্য তাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতার এই উপনির্বাচনে শাসকদল আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যেই যা কিছুটা আগ্রহ-উত্তেজনা-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (গোমস্তাপুর-নাচোল-ভোলাহাট) আসনের উপনির্বাচন স্থানীয় পর্যায় ছেড়ে জাতীয় খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ঢাকাই সিনেমার অভিনেত্রী মাহিয়া মাহি (শারমিন আক্তার সরকার) চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান। এ জন্য তিনি নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গত সোমবার ও মঙ্গলবার গণসংযোগ ও পথসভা করেছেন। তাঁকে দেখতে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। ব্যাপারটা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য হলে ঘটনাপ্রবাহ যেদিকেই মোড় নিক না কেন শেষ পর্যন্ত নায়ক বা নায়িকার জয় দেখতে আমরা  অভ্যস্ত। কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণে নানা হিসাব-নিকাশ আর বাস্তবতা থাকে। আর আওয়ামী লীগ যেখানে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে, আর ৮-৯ মাসের সংসদ সদস্য পদও যখন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য টিকিট পাওয়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে, সেখানে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে দীর্ঘ লাইনের পাশাপাশি তীব্র প্রতিযোগিতা হবেই।

এ মাসেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের আর বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচন সামনে রেখে নানা কর্মসূচি দিচ্ছে। কিন্তু দলগুলোতে নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কি আছে? দলের মধ্যেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, সরকারে গিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন তাঁরা? কারা দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন, তারও গোড়ার আলাপ হলো, কীভাবে তাঁরা মনোনয়ন পাচ্ছেন।

জানা যাচ্ছে, এ আসনে উপনির্বাচনে সাবেক দুজন সংসদ সদস্যসহ ১৪ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁরা এখন ঢাকায় প্রভাবশালী নেতাদের কাছে চেষ্টা-তদবিরে ব্যস্ত। ওদিকে মাহিয়া মাহির পথসভায় সাধারণ মানুষেরা ভিড় করছেন। এতে শঙ্কা-ক্ষোভও বাড়ছে তদবিরে ব্যস্ত মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মনোনয়নের শিকে কার ভাগ্যে ছিঁড়বে, তা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে।

আপাতত মাহিয়া মাহির মনোনয়ন প্রত্যাশা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের যে বক্তব্য, তাতে কুল-শ্যাম দুই পক্ষকেই রক্ষা করে দেখে-শুনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নীতির আভাস মিলল। দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি মাহিয়া মাহির বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বলে প্রথম আলোর খবরে জানা যাচ্ছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “ওর (মাহি) পরিবার তো আওয়ামী লীগের পরিবার। তিনিও আওয়ামী লীগ করেন। ঠিক আছে ফরম সংগ্রহ করুক।”’ তাহলে কি ওই অভিনেত্রী আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন? জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রার্থী হচ্ছেন কি না, বলতে পারব না। তাঁকে ফরম কেনার অধিকার দেওয়া হচ্ছে।’

সদ্য সমাপ্ত রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা (ডালিয়া) বড় ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলের পুরুষ নেতারাই নারী প্রার্থী মেনে নিতে চান না। দলের ভেতর উল্টো সুর, আবার বাইরেও উল্টো সুর, তাহলে নারীরা যাবেন কোথায়? নারীরা কি দাঁড়াবেন না?’

ওবায়দুল কাদেরের এ বক্তব্য থেকে নারী প্রার্থীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের পুরুষ প্রার্থীদের একটা মনোভাব জানা গেল। কিন্তু মাহিয়া মাহিদের মতো সেলিব্রিটিদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে দলের মনোভাব কী, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেল না।

ভারত-পাকিস্তান-নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্রিকেট কিংবা সিনেমা কিংবা সংগীতজগতের সেলিব্রিটিদের কদর তো কয়েক দশক ধরেই আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেই প্রবণতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। সেলিব্রিটিদের হরেদরে প্রার্থী করে নির্বাচনী বৈতরণি শুধু পাড়ি দেওয়া নয়, প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করে দেওয়া যায়, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত সীমানার ওপারের পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বর্তমান জাতীয় সংসদে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, জনপ্রিয় লোকসংগীত শিল্পী মমতাজ বেগম, চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান খান দুর্জয়, ফুটবলার সালাম মুর্শেদীসহ কয়েকজন সেলিব্রিটি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন। সেলিব্রিটিদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বিএনপিও। সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা, বেবী নাজনীন, চিত্রনায়ক হেলাল খান, ফুটবলার আমিনুল ইসলামের নাম সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে শোনা গেছে।

মাহিয়া মাহির পথসভায় যে ভিড় দেখা যাচ্ছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের ১৪ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী পথসভা করলে মানুষ কি ততটা আগ্রহী হবেন? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? প্রথমত, গণমনস্তত্ত্ব। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য এলাকার মতো আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই নিয়তিবাদী। নিয়তিবাদী মানুষের জন্য আইডল বা নায়ক প্রয়োজন। একসময় রাজনীতিকেরা জনমানুষের কাছে আইডল হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনীতিক আইডল দূরে থাক মানুষের ন্যূনতম ‘ভক্তি-শ্রদ্ধা’ অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ। বাস্তব জগতে কোনো আইডল যখন নেই, তখন পর্দার কিংবা মাঠের সেলিব্রিটিরাই জনমানুষের কাছে আইডল হিসেবে হাজির হচ্ছেন। তাদের প্রার্থী করে নিজেদের শোচনীয় রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছে রাজনৈতিক দলগুলো।

এ বাস্তবতায় মাহি যখন ‘আপনার তো কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই’—প্রশ্নে ফোন কেটে দেন, তাতে অবাক হওয়ার কি কোনো কারণ থাকে?

দ্বিতীয়ত, দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড় করানো হয়েছে যে সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে এখন আর ভোটারের মন জয় করে আসতে হয় না। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন করতে হয় না। ফলে সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন পাওয়াটাই প্রধান বাধা। চেষ্টা-তদবির অথবা অন্য যেকোনো কায়দায় মনোনয়ন বাগানোটাই মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বড় কাজ। কে, কত বছর মাঠের রাজনীতি করে এসেছে, দলের জন্য কার ত্যাগ কত বেশি, কিংবা জনগণের সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে, সেগুলো দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাবেক আমলা, উকিল–চিকিৎসক, পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এগিয়ে থাকেন প্রতিযোগিতার দৌড়ে। এমনও দেখা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার আগে দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁদের প্রার্থীকে চেনেন না। ফলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকুক আর না-ই থাকুক, যে কেউই সংসদ সদস্য হতে চান। এ বাস্তবতায় মাহি যখন ‘আপনার তো কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই’—প্রশ্নে ফোন কেটে দেন, তাতে অবাক হওয়ার কি কোনো কারণ থাকে?

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে মাহিয়া মাহি জানিয়েছেন মনোনয়ন পেতে তিনি আগ্রহী। তিনি বলেছেন, ‘সব প্রার্থীই নিজেকে যোগ্য মনে করেন, সেই অর্থে আমিও নিজেকে যোগ্য মনে করি। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নারীদের ক্ষমতায়নে আগ্রহী। নারী হিসেবে তাই আমি আশাবাদী।’

এ মাসেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের আর বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচন সামনে রেখে নানা কর্মসূচি দিচ্ছে। কিন্তু দলগুলোতে নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কি আছে? দলের মধ্যেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, সরকারে গিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন তাঁরা? কারা দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন, তারও গোড়ার আলাপ হলো, কীভাবে তাঁরা মনোনয়ন পাচ্ছেন।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক