উপজেলা নির্বাচনে জামানত বাড়ানোর অর্থ কী

শাহ মোমেন (৫৫)। পেশায় হোমিও চিকিৎসক। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন। পরে আর দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হননি। বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়েছেন। রৌমারী-চিলমারী নৌপথে অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান, রৌমারী হাসপাতালসহ অফিস–আদালতে জনগণের সেবাপ্রাপ্তির জন্য খেটেছেন। খাদ্য গোডাউনে কৃষকেরা যাতে ধান দিতে পারেন, সেখানেও তিনি। লেগে আছেন রৌমারী পর্যন্ত রেলপথ, গ্যাস–সংযোগ সম্প্রসারণ ও ইপিজেডের দাবিতে।

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। দুই লাখ মানুষের গণস্বাক্ষর এবং ঢাকা, কুড়িগ্রাম ও সব উপজেলায় মানববন্ধন, মোটরযাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি।

কুড়িগ্রাম শহরের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রায়গঞ্জ হাসপাতালের জমি অনেক বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল। সেখানে নতুন করে আবারও কার্যক্রম শুরুর জন্য আন্দোলন শুরু করে গণকমিটি। সেই আন্দোলনের সক্রিয়দের একজন ছিলেন তিনি।

এখন সেখানে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা সারা বাংলাদেশের ১৩ টির একটি। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবির আন্দোলনেও তিনি ছিলেন। সেই তিনি হলেন মামুনুর রশীদ (৩৫)।

এই বেকার যুবকটি মাঝে মাঝে হাটে সবজি বিক্রি করেন। ডিপ্লোমা পাস করেছেন কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক থেকে।

এ ছাড়া নাগেশ্বরীর দুধকুমার নদের পাড় রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের দাবি সর্বপ্রথম ওঠে তাঁর নেতৃত্বে। উপজেলার রায়গঞ্জের দামাল গ্রামে নদীর পাড়ে হাজারো মানুষের জমায়েত হয়। ফলে প্রকল্পটি পাস হয়। তারপর চলে খননের বালু নিয়ে ছিনিমিনি। জনগণকে নিয়ে রুখে দেন। দুই বছর পর বালুগুলো নিলামে ওঠে।

তাঁরা দুজনই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু জামানত ৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার করায় ভেঙে পড়েছেন। এমনভাবে ভেঙে পড়েছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার খন্দকার আরিফ, গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসী-বাঙালির ভূমিরক্ষা আন্দোলনের নেতা সামিউল রাসু, সিরাজগঞ্জের ভূমিহীন আন্দোলনের নেতা নাসির আহমেদ। তাঁরা সবাই নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয় মুখ।

রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতা বাড়ার তরিকা কী? ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির ব্যবস্থা যতটা পারা যায় করা আর একইভাবে জনগণের জন্য ক্ষমতা চর্চার পথ খুলে দেওয়া। একজন বিত্তহীন মুচিও যেন একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন সংসদ সদস্য, একজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে এটাই তফাত।

দুই.

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিধিমালা সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে বলা হয়েছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জামানত ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জামানত ৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ বিবিএস জরিপ বলছে, মধ্যবিত্তদের ধার করে সংসার চালাতে হচ্ছে।

জারি করা প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারের সমর্থনসূচক সইসহ তালিকা জমা দেওয়ার বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে এসব সংশোধনী প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী উপজেলা নির্বাচনে এসব বিধান কার্যকর হবে।

এদিকে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, সংশোধিত উপজেলা নির্বাচনের আচরণবিধি ও পরিচালনা বিধিমালায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা সবই করেছে আইন মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয় সংবিধানে ঘোষিত সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা ভোলে কীভাবে?

অশোক কুমার দেবনাথ জানান, সংশোধিত বিধি অনুযায়ী প্রার্থীদের জামানত রক্ষায় প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ ভোট পেতে হবে। এত দিন তা ছিল আট ভাগের এক ভাগ। এ ছাড়া এবার থেকে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে অনলাইনে। প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রার্থীরা জনসংযোগ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালাতে পারবেন। প্রার্থীরা সাদা–কালোর পাশাপাশি রঙিন পোস্টার ও ব্যানার করতে পারবেন।

এর ফলে নির্বাচন ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে কি না, প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার বলেন, ইসি এমনটা মনে করছে না।

আগে সংসদীয় আসনের জন্য প্রার্থীদের ২৫ হাজার টাকা, উপজেলা নির্বাচনে ১০ হাজার টাকা আর চলমান পৌরসভা নির্বাচনে ভোটার সংখ্যার হিসাবে জামানতের টাকা আগে জমা দিতে হতো। কেউ যদি প্রদত্ত ভোটের সাড়ে ১২ শতাংশ না পান, তাহলে তিনি জামানতের টাকা ফেরত পাবেন না।

পৌরসভা নির্বাচনে ছিল এক লাখের বেশি ভোটারের এলাকার জন্য ৩০ হাজার টাকা জামানত জমা রাখতে হয় নির্বাচন কমিশনে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য জামানত পাঁচ হাজার টাকা।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৯ হাজার ৫০০ টাকা আর কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে এক হাজার টাকা জামানত জমা রাখতে হয়।

এই টাকা জমাদানের প্রমাণস্বরূপ ট্রেজারি চালান বা কোনো তফসিলি ব্যাংকের পে-অর্ডার বা পোস্টাল–অর্ডার জমা দিতে হয়।

তিন.

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দুটি মানদণ্ড ঠিক করে দিয়েছে, একটি হলো রাজনীতি কীভাবে পরিচালিত হবে আর অন্যটি রাষ্ট্র নাগরিকদের কী দেবে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন, সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।’

রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতা বাড়ার তরিকা কী? ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির ব্যবস্থা যতটা পারা যায় করা আর একইভাবে জনগণের জন্য ক্ষমতা চর্চার পথ খুলে দেওয়া। একজন বিত্তহীন মুচিও যেন একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন সংসদ সদস্য, একজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ পান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে এটাই তফাত।

একটি রাষ্ট্রের গঠনের কারণ ও প্রতিশ্রুতিকে ভিত্তি ধরে যাবতীয় সিদ্ধান্ত আসতে হয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে জাতীয় জীবনের সন্ধান করেছিলেন, তা থেকে কি ইসির এই সিদ্ধান্ত এসেছে? যদি না আসে, তাহলে কি আমলারা জনগণকে বেগমপাড়ার বাসিন্দা মনে করেন? কারও পক্ষে এ দেশের জন্মের ঘোষণাপত্রের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ নেই।

  • নাহিদ হাসান সংগঠক ও কলাম লেখক

ই–মেইল: nahidknowledge1 @gmail. com