পাকিস্তান ও ইরানের পরস্পরের ভূমিতে এক দিনের ব্যবধানে পাল্টাপাল্টি হামলা দেখে মনে হতে পারে, তারা যেন বহুকালের পুরোনো শত্রু, যেন তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার কোনো সম্পর্ক নেই, যেন কোনো সমস্যাই তারা টেবিলে বসে মিটমাট করতে পারবে না।
বাস্তবতা কি আসলেই সে রকম, নাকি চলতি মিসাইল ছোড়াছুড়ি উভয় দেশের ক্ষমতাসীনদের বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে?
১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান হামলা চালিয়েছে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে। তাদের দাবি, সেখানে বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্টের বিদ্রোহীরা লুকিয়ে আছে। তারা এ হামলার নাম দিয়েছে—‘মর্গ বর শারমাচর’। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়—‘মরণ হোক বিদ্রোহীদের’। ‘শারমাচর’ একটা বেলুচ শব্দ। বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনো বিদ্রোহীদের কথা বলছে। তাদের এ হামলা ছিল ইরানের ১৬ জানুয়ারির হামলার বদলা হিসেবে।
অন্যদিকে ইরান হামলা করেছে পাকিস্তানভুক্ত বেলুচিস্তানে। তাদের দাবি, সেখানে লুকিয়ে ছিল তাদের দেশের সুন্নি বিদ্রোহী ‘জইশ আল-আদল’। আগে যে সংগঠনের নাম ছিল ‘জুনদুল্লাহ’। পাকিস্তানে হামলার আগে সিরিয়া ও ইরাকেও হামলা করেছে ইরান। প্রতিটি হামলার আগে-পরে তারা ‘শত্রুদের’ নির্মূলের অধিকারের কথা জানাচ্ছে।
এসব হামলা কি কেবলই সামরিক কারণে
পাকিস্তানে ইরানের হামলা হয়েছে শেষোক্ত দেশের ভেতর অনেকগুলো চোরাগোপ্তা হামলার পর। পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি এসব হামলায় ইরানের অনেক রক্ষী ও সেনা কর্মকর্তা মারা গেছেন। ইরানের অন্যান্য এলাকায়ও মাঝেমধ্যে চোরাগোপ্তা হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ‘শত্রুদের’ থেকে তার সীমান্ত সুরক্ষিত করতে পারছে না। এ রকম ব্যর্থতার মুখে তারা একই সঙ্গে মুসলমানপ্রধান সিরিয়া-ইরাক-পাকিস্তানে হামলা করে বসেছে।
একই দশা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীরও। স্থানীয় তালেবান ও বেলুচ সশস্ত্র গেরিলাদের হাতে তারা ব্যাপক মার খাচ্ছে। এ রকম প্রতিটি হামলার পর তারাও বিদেশি ‘শত্রুদের’ ষড়যন্ত্রের কথা বলছে।
ইরান ও পাকিস্তান ‘বিদেশি শত্রু’ বলতে কাদের বোঝায়, সেটা সবাই জানে। কিন্তু ওই শত্রুদের হামলা না চালিয়ে তারা টার্গেট করেছে বেলুচদের। এটা অসত্য নয়, ইরান ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বেলুচদের ক্ষোভ আছে। সেই ক্ষোভ দুই সীমান্তে দুই ধরনের।
বেলুচ জাতি ইরান ও পাকিস্তানে বিভক্ত। উভয় দেশে তারা নানা রকমের সমস্যায় আছে। এসব সমস্যা মেটাতে এবং বেলুচ সশস্ত্রতা কমিয়ে আনতে উভয় দেশ আলোচনার টেবিলে বসে কিছু পন্থা বের করতে পারত। সেটা না করে তারা মিসাইল ছোড়াছুড়ি করছে। এর কারণ জাতীয় স্বার্থ নয়, গোষ্ঠী স্বার্থ। আরও সরাসরি বললে উভয় দেশের শাসকদের স্বার্থ।
পাকিস্তানের ইরান অভিযানের আড়ালে সেনা আমলাতন্ত্র বেলুচ নারীদের সাম্প্রতিক লংমার্চ থেকে দৃষ্টি সরাতে চাইছে। এ ফাঁকে নির্বাচনকালে ইমরান খান ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে নেওয়া অন্যায্য প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো চালিয়ে যেতে চাইবে তারা। গত এক বছর বিভিন্ন ‘রাজনৈতিক তৎপরতায়’ দেশবাসীর কাছে তাদের ইমেজের যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটাও তারা জনমন থেকে মুছতে চাইছে।
অন্যদিকে ইরানের শাসকেরা তাদের দেশের সব সমস্যার পেছনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত দেখিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চাইছে। কেবল হিজাবসংক্রান্ত প্রতিবাদ আন্দোলনের কারণে সেখানে গত বছর পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যাঁদের অনেকে ছিলেন নারী।
পাকিস্তান ও ইরানের শাসকদের পারস্পরিক হামলায় কার্যত লাভ ইসরায়েল ও ভারতের। ইসরায়েল এ সুযোগে গাজায় তার নির্মমতা থেকে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর চোখ সরাতে পারল। পাকিস্তানের তৃতীয় একটা সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হওয়া ভারতের জন্যও স্বস্তির। পাকিস্তানকে এখন ইরানের সঙ্গে তার সাড়ে ৫০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তে নিয়মিত বাড়তি সৈন্য মোতায়েন রাখতে হবে।
পাকিস্তান ও ইরানের শাসকদের পারস্পরিক হামলায় কার্যত লাভ ইসরায়েল ও ভারতের। ইসরায়েল এ সুযোগে গাজায় তার নির্মমতা থেকে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর চোখ সরাতে পারল। পাকিস্তানের তৃতীয় একটা সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হওয়া ভারতের জন্যও স্বস্তির। পাকিস্তানকে এখন ইরানের সঙ্গে তার সাড়ে ৫০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তে নিয়মিত বাড়তি সৈন্য মোতায়েন রাখতে হবে।
এতে ভারত সীমান্তে তাদের জনবলে নিশ্চিতভাবে কিছু টান পড়বে। সামরিক ব্যয়ও বাড়বে। এ ছাড়া ইরানের বক্তব্য উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে ভারত বিশ্বজুড়ে বলতে পারবে, পাকিস্তানের আশ্রয়ে ‘সন্ত্রাসী গ্রুপ’ আছে। একইভাবে পাকিস্তানের অভিযানের সূত্রে ইসরায়েলও ইরানকে ‘সন্ত্রাসীদের’ লালনকারী হিসেবে দেখাতে পারবে।
ইসরায়েলের জন্য আরেক সুখকর অর্জন ইয়েমেনে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে নামাতে পারা। ইসরায়েলের হামলায় যখন গাজা ও দক্ষিণ লেবানন ধ্বংস হচ্ছে, তখন ওয়াশিংটনের মিসাইলে ভস্ম হচ্ছে ইয়েমেনের বিভিন্ন শহর।
আবার ইরানকে যে তারা পাকিস্তানের মতো একটা দেশের মিসাইলের লক্ষ্যবস্তু করে ফেলতে পেরেছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকেও বড় এক সফলতা। অন্যদিকে পাকিস্তান-ইরান বিবাদে নিশ্চিতভাবে কাশ্মীর প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বের একসঙ্গে বসা বহুদিনের জন্য অধরা হয়ে গেল।
গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ১০০ দিন পার হওয়ার মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল পাঁচটি মুসলমানপ্রধান দেশ—ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরান ও পাকিস্তানে। অথচ দরকার ছিল এসব দেশের একসঙ্গে ইসরায়েলকে থামানো।
বিশ্বের বড় একাংশজুড়ে এভাবে যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে লাভ তেল আবিবের। বিশেষ করে দেশটির শাসক নেতানিয়াহুর। গাজাযুদ্ধে ইতিমধ্যে তারা ২৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তবে গণহত্যা ছাড়া সেখানকার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাদের সফলতা খুব বেশি নয়। ১০০ দিন পার হওয়ার পরও তারা হামাসের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত সফলতা পায়নি। অথচ এক সপ্তাহের মধ্যে হামাসকে নির্মূলের হুমকি ছিল। সেটা ব্যর্থ হওয়ায় নেতানিয়াহু দেশের ভেতর গুরুতর প্রশ্নের মুখে আছেন।
আবার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জায়নবাদী বর্বরতায় বিশ্বব্যাপী যেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে, সে-ও ইসরায়েলের শাসকদের মুশকিলে ফেলেছে। একই মুশকিলের হিস্যা ভোগ করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনকেও। ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের গাজানীতি তাদের নিজ দলেই তীব্র বিরোধিতার শিকার। ইউক্রেনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলেও রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে না পারা বাইডেনকে প্রশ্নের মুখোমুখি করছে।
ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধে যুক্ত থাকার পরও বাইডেন ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে নিজ জনগণের করের অর্থে রীতিমতো যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন, সেটা রাজনৈতিক কারণেই। ‘ট্রাম্প’ নামের এক ভূত তাঁকে তাড়া করছে। ৯ মাস পর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
নির্বাচন থেকে ট্রাম্পকে দূরে রাখতে যতই প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, ততই তিনি অবিশ্বাস্য এক লড়াকু মূর্তিতে মার্কিন ভোটারদের মধ্যে হাজির হচ্ছেন। এ অবস্থা মোকাবিলায় দুর্বল কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ভোটারদের কাছে বাহবা নেওয়া বাইডেনের জন্য জরুরি। একই অবস্থা যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীনদেরও।
আগামী জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। সেখানকার বিখ্যাত দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট ১৯ জানুয়ারি এক জরিপের ফল তুলে ধরে লিখেছে, ৫০-এর কম বয়সী ভোটারদের মাত্র ১০ শতাংশ চলতি রক্ষণশীল সরকারকে সমর্থন করছে। সব বয়সীদের মাত্র ২০ শতাংশ ভোটার বলছেন, তাঁরা পরের নির্বাচনে ঋষি সুনাকের দলকে সমর্থন করবে। এ রকম অবস্থা বদলিয়ে জনমানসে সফলতার ইমেজ গড়তে ইয়েমেন হামলায় আগ বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শরিক হয়ে গেছে সুনাকের প্রশাসন।
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ায় বাইডেন-সুনাক জুটি মোটেই যে একা নন, সেটা ফ্রান্স ও জার্মানির ইসরায়েল নীতি থেকেও স্পষ্ট। আবার ইরান ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোও পাল্টাপাল্টি মিসাইল ছুড়ে এটা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রহীনতার সঙ্গে অস্ত্র নির্মাণ খাতের মেলবন্ধন কোথায়। যুক্তরাষ্ট্রে লকহিড মার্টিন ও জেনারেল ডায়নামিকসের মতো অস্ত্র নির্মাতাদের শেয়ারের দাম এ বছর ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বাইডেন যে সাম্প্রতিক এক টিভি ভাষণে তাঁর দেশের সমরশিল্পকে ‘আরসেনাল অব ডেমোক্রেসি’ বলেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে করুণ শোনালেও তার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা কঠিন কিছু নয়।
ইউক্রেন ও গাজায় সামরিক আগ্রাসনে একটা বিষয় স্পষ্ট, বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো এ রকম বর্বরতা থামাতে আর সমর্থ নয়, হয়তো আগ্রহীও নয়। রাষ্ট্রগুলো একে একে এমন সব কর্তৃত্ববাদী শক্তির হাতে গেছে, যাদের দরকার কল্পিত শত্রু ও নিয়মিত যুদ্ধবিগ্রহ।
এ রকম ‘যুদ্ধ’ সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের জন্যও সুবিধাজনক। তাহলে আর জনপ্রতিনিধিদের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে কে নিয়োগ দেবে, এ বিতর্কেই পাকিস্তানে ইমরানের পতন-অধ্যায়ের শুরু হয়। সেই ঘটনায় ইমরানই কেবল কারাগারে যাননি, দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই হাস্যকর করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনে ইমরানের দলের প্রতীকটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী, সামরিক আমলাতন্ত্র ও অস্ত্র নির্মাণ খাতের এই ত্রিমুখী জোট থেকে বিশ্বকে কোনো একক দেশ বা একক কোনো রাজনৈতিক দল বের করে আনতে পারবে না। এর বিকল্প হলো গণতন্ত্রী ও শান্তিবাদীদের বিশ্বজুড়ে সমাবেশীকরণ।
এর একটা নমুনা আমরা দেখছি গাজা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে শান্তি সমাবেশগুলোর মাধ্যমে। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা বৈশ্বিক ভরকেন্দ্র ছাড়াই দেশে দেশে এসব সমাবেশ হচ্ছে। নানা ধরনের সামাজিক সংগঠন এসব সমাবেশের ডাক দিচ্ছে এবং সেগুলোতে বিপুল মানুষ এসে জড়ো হচ্ছেন। এ রকম সমাবেশে আসা মানুষদের উপলব্ধি প্রায় একই রকম: জাতিসংঘ কিংবা আঞ্চলিক কোনো সংস্থার ঐকমত্য বা চুক্তি এখন আর মানুষের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
আবার পুঁজিতন্ত্র সাধারণ মানুষকে ৯টা-৫টার জীবনধারায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে স্বৈরতন্ত্র ও সমরবাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার কাজে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। পাশাপাশি সরকারগুলো দেশে দেশে জনসমাজে তীব্র ভীতির আবহ তৈরি করছে।
এই তিন বাস্তবতা পেরিয়ে সমাজে পরিবর্তনবাদী মানুষ কতটা কাছাকাছি আসতে পারছে এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্যের সেতু তৈরি করতে পারছে, তার ওপরই মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা নির্ভর করছে।
বিশ্বে আসলে ‘গাজা’ একটা নয় এবং নেতানিয়াহুও একজন নন।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক