এবার ‘গায়েবি’ সাক্ষ্যের উদ্যোগ?

আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনেরা প্রিজন ভ্যানের ফাঁক গলে স্বজনকে দেখে চিৎকার করে ডাকছেন। বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ না নিয়েও অনেককে গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠছে।
ফাইল ছবি

দেশে ‘গায়েবি’ বা বানোয়াট মামলা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। পুলিশের মাধ্যমে এমন অসংখ্য মামলা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিছু মামলায় শাস্তিও প্রদান করা হয়েছে।

গায়েবি মামলায় অনেক সময় সাক্ষ্যও হয় গায়েবি বা বানোয়াট ধরনের। এবার সে ধরনের গায়েবি সাক্ষ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলা ট্রিবিউন এর ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমন ধারণাই পাওয়া যায়। নুরুজ্জামান লাবুর তৈরি প্রতিবেদনটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘মামলায় “যথাযথ” সাক্ষ্য না দিলে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা’।

এমনিতেই জনগণের করের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে সমাজে অনেক প্রশ্ন আছে। এখন নির্বাচনের সময় গায়েবি মামলায় পুলিশের অতি তৎপরতার ভিত্তিতে বিরোধী দলের লোকদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে পুলিশের ভূমিকা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।  

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় পুলিশ সাক্ষী দিতে অনুপস্থিত থাকলে বা ‘যথাযথ’ সাক্ষী না দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে। ফৌজদারি মামলায় পুলিশকে সাধারণত বাদী হিসেবে ছাড়াও চার্জশিটের তালিকা অনুসারে সাক্ষী দিতে আদালতে যেতে হয়ে। নির্ধারিত শুনানির দিনে পুলিশ অনুপস্থিত থাকলে মামলা পরিচালনায় বিলম্ব ও বিঘ্ন ঘটে। ফলে পুলিশকে সাক্ষ্য প্রদানের দিনে হাজির থাকার নির্দেশনার মধ্যে আপত্তিকর কিছু নেই।

কিন্তু তাই বলে পুলিশকে ‘যথাযথ’ সাক্ষ্য দিতে বলার নির্দেশনার বিষয়টি এত সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। যথাযথ সাক্ষ্য মানে যদি হয় সততার সঙ্গে সাক্ষ্য দেওয়া, তাহলে তাতে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু এর মানে যদি হয় সরকারের চাহিদা বা পরিকল্পনা মোতাবেক সাক্ষ্য দিতে বলা, তাহলে প্রশ্ন থাকে।  

বাংলা ট্রিবিউন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ নিজে মামলা করার পর মামলার এজাহারের বর্ণনা মোতাবেক আদালতে জবানবন্দি না দিলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে, এমন একটি নির্দেশনা পুলিশের আইজিপির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। যদি এটি সত্যি হয়, তাহলে ‘যথাযথ’ সাক্ষ্য প্রদানের একটি মানে হলো, মিথ্যা বা গায়েবি মামলার শুনানিকালেও এজাহারের বর্ণনায় পুলিশকে অটল থাকতে হবে। বিবেকের তাড়নায়, আসামি পক্ষের জেরা বা বিচারকের প্রশ্নের মুখে তিনি সত্য স্বীকার করে নির্দোষ আসামিদের মুক্তির বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারবেন না।

উল্লেখ্য, বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলাগুলোতে সাধারণত পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ সাক্ষ্য দেন না। শুধু পুলিশ সাক্ষীর ভিত্তিতেই সাজা দেওয়া হয়েছে, এমন নজির আছে এ ধরনের মামলায়। পুলিশ সদর দপ্তরের যথাযথ সাক্ষ্যে দেওয়ার নির্দেশনার পর এখন এ ধরনের বানোয়াট এজাহার ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সাজার আয়োজন বাড়তে পারে। সার্বিকভাবে, এসব পদক্ষেপের একটি অশুভ বার্তাও রয়েছে। সেটি হচ্ছে, পুলিশকে গায়েবি মামলা রুজু করতে হবে, আদালতে গিয়েও এজাহারে যেসব বানোয়াট কথা বলা হয়েছে অবিকল সেগুলো বলতে হবে এবং সত্য কথা বলে দিলে তার ‍বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আমরা ইতিমধ্যে পত্রিকায় পড়েছি যে নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক মামলাগুলোর দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে গত এক মাসে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা কিছু মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও বেশ কিছুসংখ্যক কর্মীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার মুখে আরও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। এসব মামলায় (বিশেষ করে গায়েবি চরিত্রের) বিবেকবোধসম্পন্ন ও নির্বিরোধী চরিত্রের পুলিশ সদস্যরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বা এতে অটল থাকতে অনাগ্রহী হতে পারেন। পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি তাদের ফরমায়েশি সাক্ষ্য দিতে এবং এর ভিত্তিতে সাজার আয়োজনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

এটি উদ্বেগজনক। এমনিতেই জনগণের করের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে সমাজে অনেক প্রশ্ন আছে। এখন নির্বাচনের সময় গায়েবি মামলায় পুলিশের অতি তৎপরতার ভিত্তিতে বিরোধী দলের লোকদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে পুলিশের ভূমিকা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।  

সাক্ষ্যের বক্তব্যে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিমূলক নির্দেশনা আইন ও নৈতিকতারও পরিপন্থী। আমাদের ফৌজদারি আইনে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যেমন অপরাধ, তেমনি এমন সাক্ষ্য দিতে বাধ্য বা প্ররোচিত করাও অপরাধ।

পুলিশের অধিকর্তাদের এসব বিবেচনায় রাখতে হবে।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক