ধরলা টি বাঁধ। এই শহরের মানুষের দর্শনীয় স্থান।
ধরলা টি বাঁধ। এই শহরের মানুষের দর্শনীয় স্থান।

ধরলা টি-বাঁধ, সংকুচিত জনপরিসর ও লুঙ্গিপরাদের প্রবেশ অনধিকার

কুড়িগ্রাম শহরে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পার্ক। কিছুদিন আগের ঘটনা। এক ছোট ভাই ও ছোট বোনের দুই পরিবারের দেখাদেখি হবে। ওনারা টিকিট কেটে প্রবেশ করেছেন আগে। আমি ফোন পেয়ে চলে এসেছি। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেবেন না।

আমি: ভাই, টিকিট কত?

টিকিট বিক্রেতা সদস্য: এখানে লুঙ্গি অ্যালাউ না।

আমি: লিখিত কিছু আছে?

সদস্য: না, আমি বলছি।

আমি: লিখিত না থাকলে আমি কেন শুনব?

তিনি জানালেন, এটি এমন একটি সরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠান যাদের একটা ড্রেসকোড আছে। তিনি বললেন, আমি প্রবেশ করতে দেব না, আপনি কী করতে পারেন করেন।

আমি মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ফিরে এলাম। একটা জায়গা কতটা সাধারণের, তার মাপকাঠি হলো ওই অঞ্চলের নিম্নবিত্ত মানুষটি সেখানে প্রবেশ করতে পারে কি না।

এক.

কুড়িগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সঙ্গে উন্মুক্ত শিশুপার্ক ছিল। আগে ছিল বড় বড় আম-জাম-শিরীষগাছ ও কিছু খেলনা। এরপর সংস্কার করা হলো। গাছগুলো সব কাটা পড়ল। রংচং দিয়ে গেট হলো। রাখা হলো ১০ টাকার প্রবেশমূল্য। জুড়ে দেওয়া হলো কয়েকটা খেলনা। আর যেগুলোতে চড়তে লাগে ২০ থেকে ৫০ টাকা।

সব জায়গাতেই টিকিট। ফলে টাকাওয়ালাদের সন্তানেরা তো পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত, তারা এখানে আসার সুযোগ পায় না। আর যে গরিবের বাচ্চারা খেলাধুলা করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে, টিকিট কেটে তাদের পক্ষেও শিশুপার্কে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে ঈদ-পার্বণ ছাড়া এই শিশুপার্কে শিশুদের উপস্থিতি প্রায় শূন্য। আগে যেখানে সব সময় ছেলেমেয়েরা খেলত, এখন সেখানে ছুটির দিন ছাড়া কেউ প্রবেশ করে না।

আগে কুড়িগ্রাম কলেজ মোড়ে ছায়াঘেরা একটা চত্বর ছিল। ৮–১০টি টংদোকান ছিল। সামনে ছিল সাধারণ পাঠাগার। পুরো চত্বরে বেঞ্চগুলো ছড়ানো থাকত। শহরের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে চা এখানে পাওয়া যেত। সারা দিনরাত আড্ডা দিলেও দোকানিরা কিছু বলবেন না। রিকশাওয়ালারা রিকশা রেখে শুয়েও পড়তে পারতেন এখানকার বেঞ্চগুলোতে। আড্ডা দিতেন পুরো শহরের সংস্কৃতিকর্মীরা, লিটলম্যাগ লেখকেরা, কলেজ-স্কুলের শিক্ষকেরা। কুড়িগ্রাম শহরে কেউ বেড়াতে এসে লেখক-কবিদের খুঁজতে হলে এই চত্বরেই আসতেন। এটি ছিল সম্পর্ক নির্মাণের তলা। কীভাবে যেন এটির নাম হয়ে উঠেছিল পণ্ডিত চত্বর।

এরপর এই দোকান কয়টিকে হটিয়ে দিয়ে গড়ে উঠল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রূপসী বাংলা রেস্তোরাঁ ও কয়েকটি কসমেটিকসের দোকান। উচ্ছেদ হওয়া এক পানদোকানি মজিবুর চাচা, তাঁর দোকানের নামই রাখলেন উচ্ছেদ পান স্টোর। পণ্ডিত চত্বরটি উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুড়িগ্রামের আড্ডা ও প্রাণ উধাও। উধাও সাধারণ পাঠাগারের পাঠকেরাও। মফস্‌সল শহরের বিশেষ যে চরিত্রটি থাকে, সেটিও উধাও।

নদী, খোলা জলাভূমি, খালবিল, পাহাড়-পর্বত ও খোলা মাঠের মালিক জনগণ। এগুলো ব্যক্তিগত তো নয়-ই, সরকার বা রাষ্ট্রেরও নয়। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুরক্ষা দেওয়া। সেখানে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়িক স্বার্থে বিনোদন পার্ক বানায় কোন যুক্তিতে?

দুই.

ধরলা টি বাঁধ। এই শহরের মানুষের দর্শনীয় স্থান। বাইরে থেকে কেউ এলে তাঁকে এই দুটি টি বাঁধ দেখাতে নিয়ে যাই। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই টি বাঁধ দুটি করেছে।

এখানে দূর থেকে শিশুদের হাসি, গানের সুর ও লোকদের কথোপকথনের শব্দ শোনা যায়। মফস্‌সল শহরের রাস্তায় মা-ই তার আঙুল ছুঁয়ে চলা সন্তানের গলা শুনতে পান না, জরুরি কথা থাকলে চিৎকার করে বলতে হয়। তাই মন ভালো করার জন্য ধরলার পাড়। এখানে হেঁটে, বসে ও দাঁড়িয়ে কথা কথা যায়। বয়স্ক ব্যক্তিরা সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চে আর তরুণ-তরুণীরা ঘাসে অনায়াসে বসতে পারেন। সামনে ধরলার রূপ, প্রাকৃতিক হাসপাতাল।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে চত্বর ও সড়কগুলো হচ্ছে মানুষের সমবেত হওয়ার বা সামাজিকীকরণের স্থান। মানুষকে বাড়ির বাইরে সময় কাটানো ও হাঁটাহাঁটিতে সামাজিকীকরণ দারুণ ঘটে। মানুষ কীভাবে, কোন পরিবেশে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কোথায় বসতে পছন্দ করে, কী পরিবেশে গল্প করতে পছন্দ করে, দেখার দূরত্ব কতটুকু হবে, তার ওপর নির্ভর করে শহরের মানুষের জীবন কতটা প্রাণবন্ত হবে।

সম্প্রতি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নজর পড়েছে এই টি বাঁধ দুটিতে। শহরের মধ্যে পার্ক বানিয়ে লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় এখানেও সেটি বিস্তৃত হয়েছে। প্রথমে তারা ‘সংরক্ষিত এলাকা’ লিখে একটি রেস্তোরাঁর উপযুক্ত ঘর নির্মাণ করে। পরে প্রতিবাদের মুখে আগের সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে ‘জলযান ঘাট’–এর সাইনবোর্ড লাগিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি সাংবাদিকদের জানিয়েছে, ‘মাদকসেবীরা রাতের বেলা এলাকাটিতে ঘোরাঘুরি করে। তাই তারা এটি করেছে।’ তাহলে যত গণ–এলাকা আছে, সবখানেই তারা রেস্তোরাঁ বানিয়ে মাদকের বিস্তার ঠেকাবেন? মূলত তাদের মুনাফার জোগান দিতে মানুষের প্রবেশ সংকুচিত ও ব্যয়বহুল করা।

সম্প্রতি কুড়িগ্রামের ডিসি অফিস–সংলগ্ন পুকুরটি এ রকম একটি জায়গা হয়ে উঠেছে। এখানে বসার, হাঁটার, দাঁড়ানোসহ ব্যায়ামের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। ওখানে গেলেই ব্যায়াম করতে ইচ্ছে করবে, গল্প করতে, বসতে ইচ্ছে করবে। মাঝেমধ্যে এখানে গানের আসর ও সাহিত্য আলোচনাও হচ্ছে।

এ রকম একটি পরিবেশ ধরলার টি বাঁধটিতেও আছে। মাত্র ব্যায়ামের সামগ্রীটুকু নেই। আর একটু নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো থাকলে শহরের আরেকটি গণ–এলাকা হয়ে উঠবে। কিন্তু না, তা দখল করতে হবে। বাণিজ্যিক এলাকা বানাতে হবে।

নদী, খোলা জলাভূমি, খালবিল, পাহাড়-পর্বত ও খোলা মাঠের মালিক জনগণ। এগুলো ব্যক্তিগত তো নয়-ই, সরকার বা রাষ্ট্রেরও নয়। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুরক্ষা দেওয়া। সেখানে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়িক স্বার্থে বিনোদন পার্ক বানায় কোন যুক্তিতে?

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge1@gmail.com