যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন একজন মার্কিন ভোটার
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন একজন মার্কিন ভোটার

মার্কিন গণতন্ত্রের এই পরিণতিই তো হওয়ার কথা ছিল

মঙ্গলবার রাত থেকে আমার ফোনে একের পর এক টেক্সট মেসেজ আসছে। এসব মেসেজে জানতে চাওয়া হচ্ছে, কীভাবে এমটা ঘটল (যেহেতু আমার অনেক বন্ধু, সহকর্মী ও পরিচিতজন জানতেন, আমি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেছিলাম, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নির্বাচনে সহজেই জিতবেন)। প্রতিটি মেসেজের আলাদা জবাব না দিয়ে এই লেখায় বিস্তারিতভাবে আমি আমার ব্যাখ্যা দেব। 

২৩০০ বছর ধরে, অন্তত প্লেটোর প্রজাতন্ত্র থেকে দার্শনিকেরা জানেন, কীভাবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনতুষ্টিবাদী নেতারা এবং দুঃশাসনের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিরা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে থাকেন। প্রক্রিয়াটি সোজা এবং আমরা এখন সেটি বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। গণতন্ত্রে যে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এমনকি যাঁরা সরকার পরিচালনা বা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত, তাঁরাও অংশ নিতে পারেন। 

ধারণা করি, রিপাবলিকান পার্টির পুরো সরকারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ আমেরিকাকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবে। ভবিষ্যতে হয়তো মাঝেমধ্যে অন্যদের ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকবে, কিন্তু যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাগুলো হবে, সেগুলো সম্ভবত আর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে গণ্য হবে না। 

কোনো ব্যক্তির সরকার পরিচালনার অনুপযুক্ত হওয়ার একটি স্পষ্ট চিহ্ন হলো মিথ্যা বলা, বিশেষ করে নিজেকে জনগণের শত্রুদের (বিদেশে এবং দেশের ভেতরে) রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা। আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে চান। 

প্লেটোর মতে, সাধারণ মানুষকে তাদের আবেগ উসকে দিয়ে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কারণ তারা যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এভাবে তাদের ক্ষোভ বা ভয়কে কাজে লাগিয়ে কিছু নেতা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে। এটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের একটি মৌলিক ধারণা। এই ধারণা থেকে আমরা বুঝতে পারি, গণতন্ত্রে মানুষের আবেগ ও প্রতিক্রিয়া অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। আবেগকে কাজে লাগিয়ে সহজেই জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করা যায়। 

দার্শনিকেরা জানতেন, এই ধরনের রাজনীতি (যেখানে নেতারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসেন) সব সময় সফল হবে, এমনটা নয়। যেমন জ্যঁ-জাক রুশো বলেছেন, গণতন্ত্র তখনই সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে, যখন একটি সমাজে বৈষম্য দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায় এবং অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, যখন সমাজে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য খুব বেশি বাড়ে, তখন এই অসামঞ্জস্য ডেমাগগদের (প্রচারকদের) জন্য মানুষের ক্ষোভ এবং অবিশ্বাসকে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করে দেয়। প্লেটো মনে করেন, এর ফলে গণতন্ত্রের পতন হতে পারে। 

রুশো এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য ব্যাপক সমতা দরকার। যখন একটি সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং সমতা থাকবে, শুধু তখনই মানুষের ক্ষোভ বা অবিশ্বাসকে সহজে ব্যবহার করা যাবে না। আজকের আমেরিকায় গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় সেই সঠিক সামাজিক-অর্থনৈতিক শর্তগুলোর অভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আজ তার বিরাট ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে। এটি সমাজের ঐক্য এবং মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে দুর্বল করে দিয়েছে এবং ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। 

২৩০০ বছর ধরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শন এ কথাই বলেছে যে এমন পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। তাই ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল যদি প্রত্যাশিত হয়, তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কেন এই ধরনের পরিস্থিতি এত দিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেনি। এর প্রধান কারণ হলো, এত দিন রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটি অঘোষিত চুক্তি ছিল যে তাঁরা সীমার বাইরে গিয়ে বিভাজনমূলক এবং সহিংস ধরনের রাজনীতিতে লিপ্ত হবেন না। 

২০০৮ সালের নির্বাচনের কথা ধরুন। রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইন সে সময় বারাক ওবামার জন্মস্থান নিয়ে বর্ণবাদী গতানুগতিক কথা বলতে পারতেন বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আশ্রয় নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এই পথে যাননি। বরং, তাঁর একজন সমর্থক ওবামাকে বিদেশে জন্মগ্রহণ করা একজন ‘আরব’ বলে প্রচার করার পর তিনি সেই সমর্থককে ভর্ৎসনা করেছিলেন। সে নির্বাচনে ম্যাককেইন হেরে যান। কিন্তু তাঁকে একজন সৎ ও নিষ্কলুষ আমেরিকান রাজনীতিবিদ হিসেবে স্মরণ করা হয়। 

এটি ঠিক, আমেরিকান রাজনীতিবিদেরা নিয়মিতভাবেই নির্বাচনে জেতার জন্য সূক্ষ্মভাবে বর্ণবাদ এবং সমকামী বিদ্বেষকে ব্যবহার করে থাকেন; কারণ এটি কার্যকর একটি কৌশল। 

তবে তাঁদের মধ্যে একটি অঘোষিত চুক্তি ছিল যে এই ধরনের রাজনীতি প্রকাশ্যে করা যাবে না। এটিকে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক টালি মেন্ডেলবার্গ ‘সমতার মানদণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ হলো, সরাসরি বর্ণবাদের ওপর ভর করা নিষিদ্ধ ছিল। তার বদলে এই ধরনের বার্তা গোপন উপায়ে, যেমন ইশারা ইঙ্গিতে প্রকাশ করতে হতো। সে সময় যদিও বর্ণবাদী এবং বৈষম্যমূলক মনোভাব রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু তা প্রকাশ্যে নয় বরং ইশারার ভাষায় করা হতো। যখন সমাজে গভীর অসাম্য বা বৈষম্য থাকে, তখন এই লুকানো রাজনৈতিক কৌশল শেষ পর্যন্ত ততটা কার্যকর থাকে না, যতটা খোলামেলা বা স্পষ্ট রাজনৈতিক কৌশল হয়। 

ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সাল থেকে যা করেছেন তা হলো, তিনি পুরোনো সেই অঘোষিত চুক্তি বা নীতি ভেঙে দিয়েছেন। তিনি অভিবাসীদের ‘অপদার্থ’ এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ‘ঘরের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই ধরনের খোলামেলা ‘আমরা বনাম তারা’ রাজনীতি স্বার্থ হাসিলে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ, ট্রাম্পের মতো নেতারা যখন সরাসরি বিভেদমূলক ভাষায় কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে এগুলো সমাজের অসন্তুষ্টি এবং বৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে পারে। 

প্লেটোর মতে, যেসব ব্যক্তি এই ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তারা শেষ পর্যন্ত অত্যাচারী শাসক হিসেবে রাজত্ব করবে। ট্রাম্প তাঁর প্রচারণায় যা বলেছেন এবং প্রথম মেয়াদে যা করেছেন, তার ভিত্তিতে প্লেটোর পূর্বাভাস আবারও সঠিক প্রমাণিত হতে পারে বলে আন্দাজ করা যায়। 

ধারণা করি, রিপাবলিকান পার্টির পুরো সরকারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ আমেরিকাকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবে। ভবিষ্যতে হয়তো মাঝেমধ্যে অন্যদের ক্ষমতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকবে, কিন্তু যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাগুলো হবে, সেগুলো সম্ভবত আর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে গণ্য হবে না। 

জেসন স্ট্যানলি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ