ইউক্রেনে এখন বরফ পড়ার সময়। এর মধ্যেই ফেব্রুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহে তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের এক বছর পূর্তি হবে। এই যুদ্ধের খবর সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় আগের মতো আর বড় জায়গা পায় না। তবে মূল রণক্ষেত্রের বাইরে এই যুদ্ধকে ঘিরে কৌতূহল–উদ্দীপক অনেক ঘটনা ঘটছে। সেসব দিকে সাংবাদিকদের নজর বেশি এখন। ওই সূত্রেই আলোচনায় এসেছে ইউক্রেনের পক্ষে পাকিস্তানের বিপুল ভূমিকার বৃত্তান্ত। প্রশ্ন উঠেছে, ইসলামাবাদ কেন এই যুদ্ধে এত সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলো? কী অর্জন তাদের?
বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের চলাচল খেয়াল রাখার অনেক ‘উইপন ট্রেকার’ আছে এখন। এদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েক মাস ধরে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে, পাকিস্তান হয়ে ইউক্রেনে কনটেইনার ভরে ভরে অস্ত্র, গোলা, বারুদ ঢুকেছে বিগত মাসগুলোয়। নানা উপায়ে এ রকম সরবরাহ ঘটছে। কখনো করাচি সমুদ্রবন্দর থেকে ইউক্রেনের প্রতিবেশী পোল্যান্ডে। কখনো রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটিতে ব্রিটেনের এয়ার ক্র্যাফটের এয়ার ব্রিজের মাধ্যমে। এতে সি-১৭ গ্লোবমাস্টার পরিবহন বিমান ব্যবহার করা হয় পাকিস্তান থেকে রুমানিয়া, সাইপ্রাস ইত্যাদি রুটে। ট্র্যাকাররা আগস্টে ব্রিটেনের গ্লোব মাস্টারের অন্তত ১২টা ট্রিপ শনাক্ত করেছিল।
রুশদের প্রাথমিক অগ্রাভিযান বন্ধের পরপরই ইউক্রেনের মাটি মূলত আর্টিলারি ও মিসাইলের যুদ্ধে পরিণত হয়। উভয় সরঞ্জামে কিয়েভের টানাটানি ছিল। রুশরা ১০-১৫টা গোলা ছুড়লে ইউক্রেন ছুড়তে পারত একটা। সেই ব্যবধান পূরণে অন্য অনেকের সঙ্গে পাকিস্তান কিয়েভকে সাহায্য করে।
এভাবে পাঠানো সরঞ্জামের উৎসও অনেক। কিছু কিছু পাকিস্তানে তৈরি। সরবরাহকারী হিসেবে আছে ব্রিটেনও। নিজ দেশে প্রধানমন্ত্রী পদে ব্যাপক চড়াই-উতরাইয়ের ভেতরই ইউক্রেনের জন্য ব্রিটেন-পাকিস্তান এই যৌথ কারবার চলেছে। নির্ভরযোগ্য অনেক প্রচারমাধ্যমে এসব খবর বের হলেও পাকিস্তান কখনো প্রতিবাদ করেনি। ফলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, ‘তদন্ত’গুলো মিথ্যা নয়।
পাকিস্তান কেন ইউক্রেনের স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ তৎপরতায় শরিক হলো, এ নিয়ে অনেক ভাষ্য আছে। ভারতীয় পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন হলো, চলতি সামরিক সহযোগিতার বিনিময়ে ইউক্রেন পাকিস্তানকে এমআই-১৭ হেলিকপ্টারের উন্নয়নে সাহায্য করছে। এই হেলিকপ্টারের মূল নির্মাতা রাশিয়া হলেও উভয় দেশ একত্রে থাকার দিনগুলোয় এর যন্ত্রাংশ তৈরিতে ইউক্রেনও শরিক ছিল। সোভিয়েত সমরশিল্পের ১৭ ভাগ হিস্যা ছিল তখন ইউক্রেনের। পাকিস্তান-ইউক্রেন সামরিক সহযোগিতার সম্পর্কও নতুন নয়।
গত শতাব্দীর শেষ দশকে এই দুই দেশ প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সামরিক চুক্তিতে ছিল। তিন শতাধিক টি-৮০ ট্যাংক পেয়েছে পাকিস্তান ইউক্রেনের কাছ থেকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ইউক্রেনের কারকভ লোকোমোটিভ ফ্যাক্টরিকে বন্ধ হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে পাকিস্তানের ট্যাংকের চাহিদা। টি-৮০ ট্যাংকের আদি সংস্করণ রুশদের হলেও কিয়েভ তার গ্যাসভিত্তিক নতুন মডেল তৈরি করে। সর্বশেষ ‘এয়ার ব্রিজ’ সহযোগিতা কিয়েভ ও ইসলামাবাদকে পুরোনো লেনদেনে আরও ঘনিষ্ঠ করে থাকবে।
একই ঘটনা ব্রিটেনের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্কের গভীরতার কথাও জানাচ্ছে। অর্থাৎ পূর্বের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও ব্রিটেনের ‘স্যান্ডহাস্টে’র সঙ্গে এখনো সামরিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র।
তবে ইউক্রেনের জন্য পাকিস্তানের চলতি ভূমিকার একটা তাৎপর্যবহ রাজনৈতিক অর্থনীতিও আছে বলে দাবি কানাডাভিত্তিক খ্যাতনামা প্রতিরক্ষা সংবাদদাতা এলিজাবেথ গসলিন-মালোর। তিনি গত বছর ২২ অক্টোবর দ্য ড্রাইভে লিখেছিলেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান এমন কিছু সমঝোতায় এসেছে, যার ফল ইউক্রেনের স্বার্থে এয়ার ব্রিজ। বিনিময়ে আইএমএফের কাছ থেকে দ্রুত ঋণ পাওয়া সহজ হবে পাকিস্তানের। এ পথেই শ্রীলঙ্কার পরিণতি এড়াতে চায় দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-১৬ জঙ্গি বিমানও তারা পেতে চায় ওই একই অবদানের বিনিময়ে। শেষের চুক্তিটি প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের। ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানের এই প্রত্যাশা আটকে রেখেছিল। জো বাইডেন কেন সেই বাধা সরালেন, তার উত্তর মেলাচ্ছেন অনেকে নূর খান ঘাঁটির এয়ার ব্রিজের সঙ্গে।
ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো নিয়ে ব্রিটেন-পাকিস্তানের যৌথ কাজে রুশ প্রতিক্রিয়া সহজেই বোধগম্য। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষুধা মেটাতে রাশিয়া নিজেও অস্ত্রপাতির বিকল্প উৎস খুঁজছে। তারা গোলা, বারুদ, রকেট কিনছে পিয়ংইয়ং থেকে; ড্রোন নিয়েছে তেহরান থেকে (বিস্তারিত: লা মোঁদ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)। এই যুদ্ধে নিজেদের আকাশে ইরানের এক ইঞ্জিনের মানুষবিহীন ‘শাহেদ-১২৯’ কিংবা ‘মোহাজের-৬’ ড্রোন দেখার দাবি আছে কিয়েভের দিক থেকে। আবার অজ্ঞাত পথে ইরানের তৈরি একধরনের মর্টার পেয়েছে কিয়েভের অনুগত যোদ্ধারাও। এভাবে ইউরোপের যুদ্ধস্থল হয়েও পাকিস্তান, ইরানের মতো অনেক তৃতীয় শক্তির অস্ত্রের প্রয়োগক্ষেত্র হয়ে উঠেছে ইউক্রেন। তবে ইরান ও উত্তর কোরিয়া ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থেকে যেভাবে ইউক্রেনে ‘তৃতীয় পক্ষ’ হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারল, পাকিস্তানের একইভাবে শামিল হওয়া কিছুটা বিস্ময়কর। আরও চমক হলো, এতে মস্কোর সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ভেঙে পড়েনি। গত ১৫ সেপ্টেম্বর পুতিন উজবেকিস্তানে শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার ‘অগ্রাধিকার পাওয়া অংশীদার’ হলো পাকিস্তান।
ইসলামাবাদে এ মাসেই রুশ তেল কেনার আলাপের কথা জানা গেল। এটা তারা করতে চাইছে ডলারের পরিবর্তে উভয়ের পছন্দসই তৃতীয় কোনো দেশের মুদ্রায়। আগামী ৬০ দিনের ভেতর এই বিষয় ফয়সালা করবে দুই দেশ। নয়াদিল্লির সঙ্গে মস্কোর একই ধরনের চুক্তি আছে। একই যুক্তিতে ইসলামাবাদ অনুরূপ ‘সুবিধা’ পেতে চাইছে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানে সাড়ে চার লাখ টন গমের এক চালানও আসতে শুরু করবে। এ রকম সবকিছু যে মস্কো এবং ইসলামাবাদকে কাছাকাছি রাখার জন্য চীনের মরিয়া চেষ্টায় হচ্ছে, তা নয়। ইউক্রেনে যখন তেহরান ও ইসলামাবাদের অস্ত্র মুখোমুখি লড়ছে, তখন এ–ও দেখা গেল যে ইরান তাদের এই প্রতিবেশীকে শীতকালীন শুভেচ্ছা হিসেবে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার দামের এলপিজি দিয়েছে।
আপাতদৃষ্টে এসব তৎপরতা বিপরীতমুখী। কিন্তু এটা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব পরিস্থিতিতে সব দেশ যার যার অবস্থান থেকে কূটনীতিক ফায়দা তুলতে নিত্যনতুন কৌশল নিচ্ছে। স্থায়ী রাগ-অনুরাগভিত্তিক বিদেশনীতি নিয়ে বসে নেই কেউ।
এয়ার ব্রিজের মাধ্যমে ইউক্রেনে যখন রাওয়ালপিন্ডি থেকে অস্ত্র গেল, তার আগে গত বছর মার্চে জাতিসংঘে রাশিয়াবিরোধী নিন্দাপ্রস্তাবে ইসলামাবাদ ভোট দানে বিরত ছিল, যেমনটি ছিল ভারত। এই উভয় দেশই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রশ্নে ভারসাম্যের কৌশল নিয়ে কূটনীতির রঙ্গমঞ্চে নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিচ্ছে। এয়ার ব্রিজের মতো তিক্ত তথ্য-উপাত্তের ভেতরেও মস্কো যে পাকিস্তানকে কাছে টেনে ধরে রেখেছে, সেটা হয়তো ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে। আবার পাকিস্তান যাতে পুরোপুরি চীনের পকেটে না ঢুকে যায়, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগের নেতিবাচক পাকিস্তান–নীতি অনেকখানি পাল্টে নিয়েছে।
ভারসাম্যের এ রকম পারস্পরিক আবহ ছেড়ে একদিকে হেলে পড়তে গেলে পরিণতি কী হয়, তার নজিরও কম নেই। নিশ্চয়ই দক্ষিণ এশিয়ায় ইমরান খানের দুর্ভোগ সে রকম একমাত্র ঘটনা নয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ক্ষমতা গেল চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষেদের, নেপালের কেপি শর্মা ওলির, মালদ্বীপের আবদুল্লাহ ইয়ামিনের। ইয়ামিন ছাড়া অন্যরা নিজ নিজ দেশে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেও টিকে থাকতে পারেননি। এসব নজির এ অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর নীতিনির্ধারকদেরও স্পষ্ট কূটনীতিক বার্তা দিচ্ছে। ‘হেলে পড়া’ বিপজ্জনক!
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক