সারের মূল্যবৃদ্ধি কি কৃষির জন্য অশনিসংকেত

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। এসব সাফল্যের পেছনে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিয়ে কম দামে কৃষকদের সার সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কয়েক গুণ বাড়লেও কৃষকদের অসুবিধার কথা ভেবে সরকার এত দিন অভ্যন্তরীণ বাজারে, অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ায়নি। যার ফলে একদিকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে কৃষক সরাসরি আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন।

কিন্তু হঠাৎ করে কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং অতি দ্রুত তা কার্যকর করা কৃষকসহ দেশের মানুষকে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন করেছে। কৃষক পর্যায়ে সারের দাম প্রতি কেজি ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত দেশের কৃষকের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এবং কৃষির জন্য একটি অশনিসংকেত। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে কৃষকের কাঁচা হেঁশেলে আঁচ লেগেছে, পেটে টান পড়েছে; এবার সারের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকের মাথায় হাত উঠবে। সেচের খরচ, পরিবহনের খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সারের এই মূল্যবৃদ্ধি দেশের কৃষকদের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত করবে। কৃষক চরমভাবে দুর্দশার মধ্যে পড়বেন। ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় হলেও সারের উৎপাদন বন্ধ রাখা কিংবা সারের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মোটেও কাম্য নয়। প্রয়োজনে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময় কমিয়ে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটি বাড়িয়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষিতে বাড়তি ভর্তুকি দিয়ে হলেও সারের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত।

চালের মূল্য যেমন সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি সার কৃষকের কাছে একটি প্রতীকী উপকরণ, যার পরিবর্তন কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তাঁদের অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়, উদ্বিগ্ন করে তোলে। এতে ক্ষোভ ও অস্থিরতা তৈরি হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ততা তৈরি হয়। সারের দাম বাড়ানোয় চাষের খরচ অনেকটা বেড়ে কৃষকেরা শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হবেন না, এটি কৃষিতে চরম সংকটের ইঙ্গিতও বহন করতে পারে।

আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় কোথায় কাঁচামালের দাম বাড়ল, কোথায় প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইউরিয়ার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো কিংবা কোথায় সারের দাম চড়া হলো, কৃষকেরা সে ধার ধারেন না, মূল্যবৃদ্ধির এসব যুক্তি তাঁদের কাছে ভিত্তিহীন। কৃষকদের মূল চিন্তা তাঁদের কৃষি উপকরণের দাম বাড়ছে কি না, সময়মতো ও প্রয়োজনমতো উপকরণ পাচ্ছেন না কিংবা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পাচ্ছেন কি না। এটি না হলে কৃষক দুর্ভাবনায় পড়েন এবং কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সারের পরিমিত ব্যবহারের লক্ষ্যে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটিও বলছে, চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। সারের পর্যাপ্ত মজুত থাকার অর্থ দাঁড়ায়, এখন যে সার বাজারে বা মজুত আছে, তা বাড়তি দামে আমদানি কিংবা উৎপাদিত নয়। তাহলে যে প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক, তা হচ্ছে তাহলে এ মুহূর্ত থেকে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নীতিগতভাবে কতটুকু যৌক্তিক।
তা ছাড়া, গ্যাসসংকটের কারণে দেশে সারের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

জানা গেছে, গ্যাসের সরবরাহ না পেয়ে ইউরিয়া উৎপাদনকারী যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড প্রায় এক মাস ধরে সার উৎপাদন করতে পারছে না। চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড কোম্পানিকেও রেশনিং করে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। অন্য কোম্পানিগুলোও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সার উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাবে। এতে কৃষকেরা বেশি দাম গুনেও যে সময়মতো সার পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। সারের মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রাপ্যতা নিয়ে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতের ফসল এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এ কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল ব্যাহত হচ্ছে এবং ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সারা বিশ্ব খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ রকম বাস্তবতায় খাদ্যে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আমাদের বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করতে হলে কিংবা অন্তত স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন বজায় রাখতে অবশ্যই সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের সরবরাহ ঠিক রাখা অতি জরুরি। কারণ, এটা সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।

উদ্ভূত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় হলেও সারের উৎপাদন বন্ধ রাখা কিংবা সারের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত মোটেও কাম্য নয়। প্রয়োজনে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময় কমিয়ে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটি বাড়িয়ে বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে কৃষিতে বাড়তি ভর্তুকি দিয়ে হলেও সারের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত। কেননা, কৃষি উৎপাদন এবং কৃষকসমাজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হলে কিংবা কৃষক ও কৃষিকাজকে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত রাখতে না পারলে দিন শেষে সমগ্র জাতিকেই এর চরম মূল্য দিতে হবে।

  • ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
    ই-মেইল: faridecoru@yahoo.co.uk