ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নারীরা অসমসাহসিকতায় নেমে এসেছিলেন রাস্তায়
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নারীরা অসমসাহসিকতায় নেমে এসেছিলেন রাস্তায়

গণ-অভ্যুত্থানের মেয়েরা কোথায় হারাল

মাত্র তিন মাস আগেই, জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি মেয়েরা কীভাবে রাজপথগুলোর দখল নিয়েছিল। পথে নেমে এসেছিল নানা বয়সী হাজারো মেয়ে। অকুতোভয় স্লোগানে আর গ্রাফিতিতে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল চারদিক। ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেডে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অভাবনীয়। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ।

মিছিলের সামনে থেকেও পুলিশের গুলি ও লাঠির আঘাত থেকে রেহাই পায়নি মেয়েরা। কয়েকজন নারী নিহতও হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দুই তরুণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হেলমেট বাহিনীর লাঠির ছবি। আর এক তরুণী কী অসমসাহসে একা দাঁড়িয়ে পড়েছে পুলিশের প্রিজন ভ্যানের সামনে, যেন দুহাত দিয়ে আটকে দেবে সব আগ্রাসন। এই সব ছবি ভাইরাল হয়েছিল দেশে-বিদেশে, প্রেরণা আর সাহস জোগাচ্ছিল সবাইকে। 

আমরা ছবিতে ও ভিডিওতে ভাইরাল হতে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছেন, পিঠ পেতে দিচ্ছেন পুলিশের লাঠির নিচে। দেখেছি পুলিশের ভ্যানে ওঠানোর সময় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া সন্তানকে পিঠে চাপড় মেরে সাহস দিচ্ছেন মা। দেশের অন্য অঞ্চলেও প্রতিবাদে বিক্ষোভে মুখর ছিল আমাদের মেয়েরা। স্কুলের বালিকা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণী, পোশাককর্মী, গৃহবধূ, মায়েরা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, অভিনেত্রী, শিল্পী, গায়িকা—কে ছিল না এই আন্দোলনে? 

অথচ কয়েক মাস যেতে না যেতেই এই অভ্যুত্থানের ইতিহাস থেকে যেন মেয়েরা হারিয়ে যেতে শুরু করল। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জুলাই-আগস্টে নিহতদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানে ছয়জন বিভিন্ন বয়সী নারীর নাম রয়েছে। অথচ ১৪ আগস্টে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মায়া ইসলাম (৬০) ও নাছিমা আক্তারের (২৪) নিহত হওয়ার ঘটনা ছবিসহ উল্লেখ থাকলেও তাঁরা বাদ পড়েছেন এই তালিকা থেকে। বাদ পড়েছেন ফেসবুকে দেখা ১৭ বছরের তানহা বা নাফিসা মারওয়া। হয়তো এভাবে বাদ পড়ে গেছেন আরও অনেকে, যাঁরা আহত হয়েছেন বা অঙ্গ হারিয়েছেন।   

আন্দোলনে অন্য নিহত ছাত্রদের মতো হিরো হয়ে উঠতে পারেনি মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী নাইমা সুলতানা। নাইমার জন্য হয়নি কোনো চত্বর, কোনো দেয়ালের নাম। মুগ্ধ বা ফারহানকে প্রতিনিয়ত মনে রাখলেও আমরা নাইমার কথা ভুলে গেছি। অন্যান্য সমন্বয়কদের সঙ্গে ডিবি কার্যালয়ে আটক ছিলেন সমন্বয়ক নুসরাতও, তিনিও এখন যেন উধাও হয়ে গেছেন গোটা দৃশ্যপট থেকে। কেন এমনটা হলো?  

৫ আগস্টের পর থেকে গোটা আন্দোলন নিয়ে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যে মেয়েরা স্লোগানে-বিক্ষোভে-প্রতিবাদে রাজপথ মুখর করে রেখেছিল, যাদের ছাড়া এই আন্দোলন কখনোই সফল হতো না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা, এখন সেই মেয়েদেরকেই হারিয়ে যেতে দেখছি আমরা। 

মিনাল শ্রীবাস্তব তাঁর ‘ইনভিজিবল উইমেন ইন হিস্ট্রি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজ’ প্রবন্ধে একটি উদাহরণ দিয়েছিলেন এমন, ১৯৩০-৩১ সালে ভারতে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ৮০ হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৭ হাজার ছিলেন নারী। অথচ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে কোথাও তাঁদের স্থান মেলেনি। এভাবে মেয়েরা পরিসংখ্যান আর তথ্য-উপাত্ত থেকে হারিয়ে যায়। তখন গোটা বিষয়টা শুধু পুরুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমরা যেন এমনটা ঘটতে দেখছি। 

৩ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘এই আন্দোলনে মেয়েদের সম্পৃক্ততা ছিল বিরাট। এখন অনেকে ভুলে গেলেও এ কথাটা সত্য যে মেয়েরা না থাকলে এই আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হতো না।’

ধন্যবাদ তাঁকে এই সত্য তুলে ধরার জন্য। কিন্তু আর দশজন আন্দোলনকারীর মতো মেয়েরাও যে আদর্শগতভাবে সাহসের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল, এই ন্যারেটিভে কেন যেন তা অনুপস্থিত। 

বিগত সরকারের আমলে নানাভাবে মেয়েরাও যে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলপরী বেগম বা অভিনেত্রী নওশাবার কথা স্মরণযোগ্য। সেই মেয়েদের অবদানের কথাও আমরা অনেকে মনে রাখিনি। 

৫ আগস্টের পর থেকে গোটা আন্দোলন নিয়ে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যে মেয়েরা স্লোগানে-বিক্ষোভে-প্রতিবাদে রাজপথ মুখর করে রেখেছিল, যাদের ছাড়া এই আন্দোলন কখনোই সফল হতো না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা, এখন সেই মেয়েদেরকেই হারিয়ে যেতে দেখছি আমরা। 

সুযোগসন্ধানী একটি গোষ্ঠী মেয়েদের পোশাক নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। নির্যাতিত হচ্ছেন রাস্তার যৌনকর্মীরা, পথেঘাটে ক্যাটকলিং বা বুলিং যেন হঠাৎ করেই বেড়ে যাচ্ছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক বুলিং ও ট্রলের শিকার হয়েছিল তখন, এখনো হচ্ছে। ডিবি কার্যালয় থেকে ছাত্র সমন্বয়কদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন যে শিক্ষক সামিনা লুৎফা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ট্রলের মাধ্যমে তাঁকে একপ্রকার কোণঠাসা করে ফেলা হলো। 

আর বেশ অবাক ব্যাপার যে গোটা আন্দোলনে নারী সমন্বয়কদের জোরালো ভূমিকা থাকলেও উপদেষ্টা পরিষদের দুজন সদস্য এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের তিন বিশেষ সহকারীর তালিকায় স্থান হয়নি কোনো নারীর। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানও সবাই পুরুষ। 

নারীর অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সংস্কার পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। দেখা যাচ্ছে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার পরও অধিকার আদায়ের বেলায় মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে ক্রমাগত। ক্রমাগত যেন চলে যাচ্ছে দৃশ্যের বাইরে। 

এবারই সব আশঙ্কা, সব দ্বিধা পায়ে মাড়িয়ে বিপুলসংখ্যক সাধারণ নারী পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিজমে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন তাঁরা। সাধারণ নারীরা তো বটেই, যাঁরা আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন, তাঁরাও। অথচ বাস্তবতা হলো এই যে আমাদের দেশে আরও বেশিসংখ্যক নারীর রাজনীতিতে আসা উচিত, সব স্তরে নারীর কণ্ঠ শোনার মতো পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য এটা খুব দরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের পর জনসংখ্যার অর্ধেক জুড়ে থাকা এই অদৃশ্য নারীরা কি ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবেন?

তানজিনা হোসেন চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক