কথায় কথা বাড়ে জেনেও ঠ্যাটা পাবলিক সমানে কথা বলে। আকথা-কুকথা যা মুখে ও মনে আসে তাই বলে। কারণ নীরবতা আমজনতার স্বভাবধর্ম না। কিন্তু মন্ত্রী-আমলারা তো ‘আম’ জনতা না; তাঁরা ‘আঙুর’ ওরফে খাসজনতা। তাঁদের জন্য ‘সব কথা কহতব্য নয়’। কিন্তু তাঁরা বলে যাচ্ছেন। কার কোনটা বলা উচিত, কোনটা উচিত না—তার ধার তাঁরা ধারছেন না। কোন কথার ক্রিয়ায় কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে; কোন কথার অর্থ আছে, কোন কথা অর্থহীন; কোন কথা জনসমক্ষে উচ্চারণীয় নয়, কোন কথা জনান্তিকেও বলা চলে না, কোন কথা ভাবাও অনুচিত—এসব বিবেচনার দায় এবং সময় কোনোটাই তাঁদের নেই।
এক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঠেলায় যখন ঠেলাগাড়ি ফিরে আসছে; যখন ডিমের হালি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে; ডলারের দাম যখন ১২০ টাকার আগায় উঠেও ওড়ার গতি কমাচ্ছে না; চালের দাম বাড়ার গতি দেখে ভাতের চিন্তায় হাভাতে মানুষের বুক যখন ধক করে উঠছে; দামের তাপে তেতে ওঠা তেল-নুন-তরিতরকারিতে যখন হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না; ১০ বছরে দেশের দুইটি বাজেটের সমান ফরেন কারেন্সি যখন ফরেনে পাচারের খবর ফেসবুকের নিউজফিডে দৌড়াদৌড়ি করছে; মাত্র এক বছরেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা দাঁড়ানোর খবর যখন হাড় হিম করে দিচ্ছে; যখন শিক্ষামন্ত্রী বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ রাখার কথা বলছেন; এসব দেখে যখন আমজনতার আর ভয় না পেয়ে উপায় থাকছে না; ঠিক সেই সময় মাননীয় মন্ত্রীরা বাঁধাই করে রাখার মতো সব কথা নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন।
জিডিপি আর মাথাপিছু আয়ের খটোমটো এবং ভুলভাল হিসাব দিয়ে তাঁদের কেউ কেউ জনগণকে ‘নো টেনশনে’ থাকতে বলছেন; কেউ ভাত কম খেতে বলছেন; কেউ গমের আটার বদলে চাল পিষে আটা বানিয়ে চালের রুটি খেতে বলছেন; কেউ ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা বর্ণনা শেষে অঙ্ক করে রিজার্ভ বিতর্কের মীমাংসা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন দাম এখনো যথেষ্ট কম আছে।
কয়েক দিন আগে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেছিলেন, ‘খাব না, গমের আটার রুটি খাব না। তাহলে আমার গম ইমপোর্ট করতে হবে না। আমার ফরেন কারেন্সি যেটা আছে, সেটাতে শর্ট পড়বে না। আমার ডলার শর্ট পড়বে না।’ এরপর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে।...আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’ এরপর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আশ্বস্ত করলেন, ‘দুশ্চিন্তা করবেন না, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না।...আর মাত্র এক মাস। আমরা আগের অবস্থানেই ফিরে যাব।.... এখনো কেউ জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মারা যায়নি। আশা করি মরবে না।’
তর্কশীল মানুষ অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে এবং নিজের কথা যুক্তি দিয়ে বলে। আর যুক্তি দাবি করে সংযম। অতিকথন ও কুকথা যথার্থ তর্কের সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস, প্রকৃত অর্থে তা বক্তারই শত্রু। মন্ত্রী মহোদয়দের এই সব সমকালীন লাগামছাড়া কথাবার্তা এই সত্যকে অতিমাত্রায় প্রকট করে তুলছে।
সর্বশেষ বোমা ফাটালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। গেল শুক্রবার তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ থেকে এমন প্যানিক ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি।’ এখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘অন্য দেশের’ সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করেছেন। সেই ‘অন্য দেশ’ আসলে কোন দেশ? সে দেশ কি যুক্তরাজ্য? যুক্তরাষ্ট্র? আফগানিস্তান? পাকিস্তান? নাকি শ্রীলঙ্কা? সেসব দেশে কি আমাদের মতো ‘সবার গায়ে জামাকাপড় আছে’?
ইবনে বতুতা অতি সস্তায় খাবার আর জিনিসপত্র পেয়ে প্রতিকূল আবহাওয়ার এই দেশকে ‘দোজখপুর নিয়ামত’ বা ‘ধনসম্পদপূর্ণ দোজখ’ বলেছিলেন। এত দিনে তা আমাদের মন্ত্রীর জবানিতে ‘অন্য দেশের তুলনায় বেহেশত’ হয়ে ধরা দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান এই অর্থনৈতিক অস্থিরতায় গোটা দেশে যে আতঙ্কজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেই অবস্থাকে ‘বেহেশতি পরিবেশ’ মনে করে কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় কি চিৎকার করে বলা যায় ‘আয় বেহেশতে কে যাবি আয়’?
প্রশ্ন হলো, যে কথা সাধারণ মানুষকে ধাক্কা দেয় এবং তাদের অসহায় অবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে, আচমকা একের পর এক সরকারের মন্ত্রীরা সেসব কথা কেন বলছেন? এটি কি ন্যাচারাল ফেনমেনা বা প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ? নাকি এটি তাঁদের নিজেদের মধ্যে আত্মপ্রচারের এক দুর্নিবার প্রতিযোগিতার ফল?
কুকথার আকর্ষণ বেশি। তাই জনপরিসরে তাঁদের কথার পরিমাণ যত বাড়ছে, গলার আওয়াজ যত চড়ছে, তাতে তাঁদের বক্তব্যের গুণমান ও বিশ্বাসযোগ্যতা তত পড়ছে। মনে হচ্ছে, নিজের বক্তব্য জনসমক্ষে জাহির করার তাগিদ তাদের এমনভাবে মোহাবিষ্ট করে ফেলছে যে, কী বললে এবং কত জোরে বললে মানুষ তা শুনবে এবং তা নিয়ে আলোচনা করবে, সেটিই তাঁদের আসল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচারমাধ্যমের বিপুল ব্যাপ্তি তাঁদের এই লক্ষ্য পূরণের অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে।
এই অতিকথনকে ‘তর্কশীলতা’ বলে ভুল করার কারণ নেই। তর্ক অন্য জিনিস। তর্কশীল মানুষ অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে এবং নিজের কথা যুক্তি দিয়ে বলে। আর যুক্তি দাবি করে সংযম। অতিকথন ও কুকথা যথার্থ তর্কের সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস, প্রকৃত অর্থে তা বক্তারই শত্রু। মন্ত্রী মহোদয়দের এই সব সমকালীন লাগামছাড়া কথাবার্তা এই সত্যকে অতিমাত্রায় প্রকট করে তুলছে।
মনে হচ্ছে, ‘তেলের শিশি ভাঙা’ অবোধ শিশুদের তুলনায় ‘বুড়ো খোকা’দের নির্বুদ্ধিতা যে আরও ভয়ানক, তা অন্নদাশংকর রায় বলেছিলেন বটে, আমরা এই এত বছরেও তার অন্তর্দর্শন ধরতে পারিনি।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com