ডেভিড লেস্টার বর্তমান সময়ের ‘আত্মহত্যা’ গবেষক। দশকের পর দশক গবেষণা করেও আত্মহত্যার আসল কারণগুলো ধরতে না পেরে হতাশ ছিলেন। গবেষণার একপর্যায়ে তাঁর নিকটবন্ধু এক নারীর মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতার কিছু লক্ষণ দেখলেন। নারীটির ব্যক্তিগত জীবনে টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু তাঁর চারপাশে সাহায্য-সহযোগিতা, সেবা, সহমর্মিতা, চিকিৎসাসুবিধা—কোনোটিরই অভাব ছিল না। পরিবার ও বন্ধুমহলের কাছ থেকে বেঁচে থাকার প্রণোদনা-উদ্দীপনা পাওয়ারও অনেক সুযোগ ছিল। লেস্টার অবাক হলেন, যখন নারীটিও আত্মহন্তা হলেন। বুঝলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধের সনাতন উপায়গুলো, যেমন সমাজ, পরিবার, স্বজন, বন্ধুমহল, ভালো জীবন-জীবিকা, বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা ইত্যাদিই যথেষ্ট নয়।
আত্মহত্যার কারণ আরও গভীরভাবে বুঝতে লেস্টার আত্মহননকারী বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী ও লেখালেখি পর্যালোচনায় নামলেন। সেই আলোকে লিখলেন ‘বিদায়রোদন’ ( এক্সিট উইপিং: আন্ডারস্ট্যান্ডিং সুইসাইড থ্রু দা স্টাডি অব ফেমাস সুইসাইডস) শিরোনামের গ্রন্থটি। বইটির শেষ প্যারাগ্রাফে লিখলেন, ‘বিখ্যাত মানুষদের আত্মহননগুলো বিখ্যাত ছিল না। তবে তাঁদের কাহিনিগুলো অন্তত আমরা জানি। তাঁরা সংখ্যায় আর কজনই-বা হবেন? বেশির ভাগ আত্মহত্যাকারীই বিখ্যাত নন। তাঁদের জীবনীও লেখা হয় না। কিন্তু বিখ্যাতজনদের মতো একই অসহনীয় ব্যক্তিগত জীবনযন্ত্রণাই তাঁদের আত্মহননের পথ ধরতে বাধ্য করে।’
লেস্টার পাঠে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, নীতিকথা আত্মহত্যা থামায় কমই। বিখ্যাত আত্মহত্যাকারীর প্রায় সবাই অন্যদের জন্য নীতি-ভাবনা দিয়ে যেতে পারলেও নিজেরাই লাভবান হতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ‘আত্মহত্যা সমাধান নয়’ আপ্তবাক্য না আওড়ানোই ভালো। আত্মহত্যাকারীর বিবেচনায় আত্মহত্যাই সমাধান। তৃতীয়ত, ‘আত্মহত্যাকারীদের জীবনবোধে ঘাটতি রয়েছে’, কথাটিও আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ধারণা নয়।
বাংলাদেশে আত্মহত্যাকে দুর্যোগ বিবেচনা করা দরকার। কারণ, দুর্যোগের মতো বিশেষ সময়ে প্রবণতাটি বাড়ে। দুর্যোগকাল চিহ্নিত করার জন্য বিস্তারিত পর্যালোচনা দরকার। তবে আপাতত একটি দিকে গভীর নজর দেওয়ার মাধ্যমে দুর্যোগ প্রস্তুতি শুরু করা যেতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর আগে-পরে এবং ফলাফল প্রকাশের কালে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার ব্যবস্থা রাখা দরকার।
অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস হলেন কথা, কাজ, সিনেমাদর্শনে জীবনবাদের প্রচারক। তিনিও আত্মহত্যা করেছেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ, ভার্জিনিয়া উলফসহ বিখ্যাতজনও ছিলেন জীবনবাদী। দুর্দমনীয় বিষণ্নতা আর মানসিক একাকীত্ববোধ তাঁদেরও আত্মহত্যায় বাধ্য করে। চতুর্থত, আত্মহত্যার চিন্তা অসুখ-বিসুখের মতো। বছরজুড়ে বা জীবনজুড়ে থাকে না। বিশেষ কোনো সময়ে তাড়নাটি তৈরি হয়। তারপর দুর্ঘটনাটি ঘটে দ্রুত।
মহামন্দা, মহামারি, মড়ক, খরা, দুর্ভিক্ষ ও ফসলহানির সময় যেমন আত্মহত্যা বাড়ে, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেও বাড়ে। মানসিক চাপ বাড়ছে, অথচ সেটি কমানোতে সহায়ক সহানুভূতিশীল পরিবেশ কমছে—এ রকম বৈপরীত্যও আত্মহত্যা বাড়ায়। আত্মহত্যা-দুর্যোগ মোকাবিলায় এই বাস্তবতা আমলে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরামর্শমতে ‘শক্তিশালী সংযোগ’ আত্মহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান কার্যকর কৌশল। সামাজিক মাধ্যমেও কারও আত্মহত্যার ইঙ্গিত মিললে তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেই তা করা সম্ভব হচ্ছে। উন্নত দেশে ব্যবস্থাটিকে বলা হচ্ছে ‘চিকিৎসা-যোগাযোগ’।
‘অ্যানোমি’ বা ‘নর্মলেসনেস’—ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী দুর্খ্যেইমের কালোত্তীর্ণ তত্ত্ব। অর্থ ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ রোগ’। নীতিনৈতিকতায় চূড়ান্ত অনাস্থাজনিত আত্মনৈরাশ্য। দ্যুর্খেইম বলেছিলেন, সামাজিক প্রতিবেশ দিয়েই আত্মহত্যাকারীর আত্মহত্যার মানসিক পরিবেশ তৈরি হয়। নিজেকে তাঁর পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বা বেমানান বোধ হতে থাকলেই তিনি আর বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পান না।
সামাজিক পরিবেশে একাত্মতার সুবিধা যত কমবে, ততই আত্মহত্যা বাড়বে। তাই আত্মহত্যা গ্রামের চেয়ে শহরে ও উষ্ণমণ্ডলের চেয়ে শীতমণ্ডলে বেশি। ধর্মাচারীদের চেয়ে ধর্মচর্চাহীনদের মধ্যে বেশি। কৃষিসমাজের চেয়ে পুঁজিবাদী শিল্পসমাজে বেশি। ক্যাথলিকদের চেয়ে প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বেশি। খেটে খাওয়া আমমানুষের চেয়ে শিক্ষিত ও সংবেদনশীলদের মধ্যে বেশি। আমনাগরিকদের চেয়ে সেনাসদস্যদের মধ্যে বেশি ইত্যাদি। লক্ষণীয়, তাঁর তত্ত্বেরও কথা, যোগাযোগ বেশি, আত্মহত্যা কম; যোগাযোগ কম, আত্মহত্যা বেশি।
দুর্খ্যেইমের দেখা ঊনবিংশ শতকের চাইতে একবিংশ শতকের বাস্তবতায় ভিন্নতাও দেখা যাচ্ছে অবশ্য। ধনী দেশগুলোতে তরুণেরা নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর তরুণদের চেয়ে অনেক বেশি ‘অ্যানোমি’গ্রস্ত। অথচ অ্যানোমি তাঁদের ততটা আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলছে না। মাদক ও মানসিক রোগজনিত সমস্যা বাড়লেও তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় কমতির দিকে। এই উন্নতির উপায় হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাহবা পাচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমের যুগে ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি, বিশ্বায়ন ইত্যাদি জনসমাজকে একটি পরিবারের রূপ দিয়েছে। পাশাপাশি অবস্থান না করলেও মানুষের যোগাযোগের নৈকট্য আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। একজন অন্তর্মুখী মানুষও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন। তাঁরও বড়সড় সমাজপরিসর তৈরি হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম একটি ভার্চ্যুয়াল সমাজ জন্ম দিয়েছে। এই সমাজের সদস্যদের মধ্যেও সম্পর্ক, আত্মীয়তা, পারস্পরিকতা ইত্যাদি বাড়ছে। এত মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে উন্নত দেশের উল্টোটা ঘটছে কেন? আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা না ঘুচে উল্টো বাড়ছে কেন?
ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে না পেরে দেশে নানা সময়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। প্রতিবছরই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর অকৃতকার্যদের মধ্য থেকে একাধিক আত্মহত্যার খবর আসে। আগেও বেশ কয়েকবার লিখেছিলাম এই বিশেষ সময়গুলোতে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার আগাম প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতামূলক যেকোনো পরীক্ষার আগে অসংখ্য তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার তাড়না বোধ করেন। তাই বলে পরীক্ষাব্যবস্থা তো আর বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। দরকার এই সব সময়কে ‘আত্মহত্যা ঝুঁকিকাল’ বিবেচনা করা এবং রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ বিবেচনায় মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া।
৭ জুন কুমিল্লায় চার বছরের শিশুকন্যাকে হত্যা করে মা আত্মহত্যা করেছেন। ৮ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এবং ৯ জুন শাহরিয়ার কবির তনয়া মুমু আত্মহত্যা করলেন। পত্রিকায় অপ্রকাশিত রয়ে যাওয়া আত্মহত্যার ঘটনা আরও কয়েক গুণ বেশি। গত এক দশকে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পর অপমৃত্যুর দ্বিতীয় বড় কারণ আত্মহত্যা।
৩০ মে মুরাদ নীল নামের একজন আত্মহত্যা করেছিলেন। নীল ছিলেন সংবেদনশীল ও পড়ুয়া যুবক। জীবনবোধ ও মানবিকতাবোধে উচ্চকিত। শিল্পসাহিত্য ও দর্শনের গভীর থেকে আরও গভীরে নোঙর ফেলে ফেলে চলা মানুষ। আত্মহত্যার কয়েক দিন আগে দেওয়া নীলের ফেসবুক পোস্টেই ইঙ্গিত ছিল তিনি আত্মহত্যা নিয়ে ভাবছেন। সেটি ভাই, বন্ধু, স্বজন ও ফেসবুকবাসীদের নজরে এলেও কেউ এগিয়ে যাননি। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা-যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলে হয়তো নীল বেঁচে যেতেন। সামাজিক মাধ্যমের বন্ধুরা আমরা নামেই তাঁর বন্ধু রয়ে গেলাম। অথচ সামাজিক মাধ্যমের জনশক্তিও হতে পারত নীলের মতো সংবেদনশীল মানুষদের বেঁচে থাকার মানসিক আশ্রয়, নির্ভরতার ছায়া।
প্রেম-ভালোবাসা, দাম্পত্য অশান্তি, অপবাদ, ট্রমা, অনিরাময়যোগ্য অসুখের যন্ত্রণা, বঞ্চনা, প্রতারণা ইত্যাদি সারা বছরের সমস্যা। আমরা এখনো ভাবিনি সেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা-তাড়না ঠেকাতে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এবং বিশেষ সার্বক্ষণিক জরুরি টেলিফোন সেবার দরকার। আত্মহত্যা-তাড়নাগ্রস্তরাও বাঁচতে চান। নিস্তারের উপায় খোঁজেন।
ফোন ক্যামেরা, ইন্টারনেটের বিস্তৃতি ও এর অপব্যবহারের কারণে যৌন অপরাধসহ নারীদের নির্যাতনের শিকার হওয়া বাড়ছে। প্রতিক্রিয়ায় ভুক্তভোগীদের আত্মহত্যা বাড়ছে। সাইবার অপরাধ দমন আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থা; চিকিৎসাব্যবস্থা নয়। অপরাধের শিকার সাক্ষী বা বাদী বিবেচিত হলেও চিকিৎসাপ্রার্থী বিবেচিত হন না। তাঁর ভেতরের গভীর ক্ষত, যা তাঁকে জীবনবিমুখ করে তুলছে, সেটি নিরাময়ের ব্যবস্থাটি আগে দরকার হলেও কার্যত ভাবনাটি এখনো শুরুই হয়নি বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে আত্মহত্যাকে দুর্যোগ বিবেচনা করা দরকার। কারণ, দুর্যোগের মতো বিশেষ সময়ে প্রবণতাটি বাড়ে। দুর্যোগকাল চিহ্নিত করার জন্য বিস্তারিত পর্যালোচনা দরকার। তবে আপাতত একটি দিকে গভীর নজর দেওয়ার মাধ্যমে দুর্যোগ প্রস্তুতি শুরু করা যেতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর আগে-পরে এবং ফলাফল প্রকাশের কালে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার ব্যবস্থা রাখা দরকার। বছরজুড়ে জরুরি সেবাদানের জন্য বিশেষ জরুরি টেলিফোন এবং ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করাও প্রয়োজন।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।