সাধারণের মধ্যে এ ধারণা রয়েছে, বাংলা মাতৃভাষা হওয়ার কারণে আমরা বাংলার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল নই।
সাধারণের মধ্যে এ ধারণা রয়েছে, বাংলা মাতৃভাষা হওয়ার কারণে আমরা বাংলার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল নই।

মতামত

বাংলা পড়েও আমরা কেন বাংলা শিখছি না

স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে অন্তত ১২ বছর বাংলা পড়ানো হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আরও চার থেকে পাঁচ বছর বাংলা পড়ার সুযোগ রয়েছে। জীবনের দীর্ঘ পরিসরজুড়ে বাংলা পড়েও আমাদের শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষায় দুর্বল থেকে যাচ্ছেন। তাঁরা বাংলা ভালো লিখতে পারছেন না, বাংলা লেখা সম্পাদনাও করতে পারছেন না। ইংরেজির ক্ষেত্রেও একই ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। তা নিয়ে কথাও বলেন অনেকে। কিন্তু বাংলার দুর্বলতা নিয়ে একটু দীর্ঘশ্বাসও শোনা যায় না। 

পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন, প্রকাশনা সংস্থা ও নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায়ই বাংলা জানা শিক্ষার্থীর খোঁজ করা হয়। সবাই মনে করেন, যাঁরা বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করেছেন, তাঁরা নিশ্চয় বাংলা ভালো জানেন। লেখালেখির কাজ থেকে শুরু করে ভাষা-সম্পাদনার কাজ এসব শিক্ষার্থী ভালো পারবেন বলে অনেকের ধারণা। লজ্জা নিয়েই বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এ কাজে বাংলার শিক্ষার্থীদের বাড়তি দক্ষতা তৈরি হয় না।  

এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা বিষয়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও পাঠদানের পদ্ধতিতে ঘাটতি রয়েছে। তাই বাংলা বিষয়ের অধীন ৩০ থেকে ৪০টি কোর্স সম্পন্ন করেও ভাষাগত দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে। এসব কোর্সের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে; কিন্তু তা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঠ্যবিষয় নির্ধারণ করার পরে। অথচ ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হওয়ার কথা। মানে, আগে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবিষয় নির্ধারণ করতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, পাঠ্যক্রম তৈরির আগে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা দরকার ছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অধিকাংশ বিষয়ের মতো বাংলা বিষয়েরও কোনো শিক্ষাক্রম নেই। ফলে শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে কতটুকু দক্ষতা অর্জন করবেন কিংবা কীভাবে অর্জন করবেন, এর দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা’ নামে আসলে বাংলা সাহিত্য পড়ানো হয়। নামমাত্র ভাষাবিজ্ঞান বা ব্যাকরণের কোর্স আছে। সেসব কোর্সের গঠন এমন, যা দৈনন্দিন জীবনে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। ভাষা-সম্পাদনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও বাংলার শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতা তৈরি হয় না। এমনকি সাহিত্য হিসেবে বাংলা পড়লেও তাঁরা সাহিত্যিকদের ভাষা ব্যবহারের বিশেষত্বও চিহ্নিত করতে পারেন না। পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা কিছু তালিকা করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করেন মাত্র। সাহিত্য পড়লেও সাহিত্য বিচার করার গুণও তৈরি হয় না তাঁদের মধ্যে। অথচ শিক্ষাক্রম থাকলে শিক্ষার্থীদের অর্জনযোগ্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা যেত। সেই অনুযায়ী পাঠ্যক্রম তৈরি করলে তা অধিকতর কাজেরও হতো। 

ভাষাদক্ষ শিক্ষার্থী তৈরির জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নের সময় লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে। পাঠ্যবই প্রণয়ন, পাঠদানের পদ্ধতি নির্ধারণ ও মূল্যায়নের প্রক্রিয়া ঠিক করার ক্ষেত্রেও সেই লক্ষ্যের কথা মাথায় রাখতে হবে

বাংলার শিক্ষার্থীরা হয়তো কবিতা লিখবেন না, কিন্তু তাঁদের কবিতা বুঝতে পারার কথা। তাঁরা হয়তো নাটকে অভিনয় করবেন না, কিন্তু নাটক দেখে আলোচনা লিখতে পারার কথা। হয়তো কবিতা আবৃত্তি করবেন না, কিন্তু উচ্চারণের ত্রুটি ধরতে পারার কথা। নিদেনপক্ষে বাংলার শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয়ের বিবরণ দেওয়া বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারার কথা এবং সমালোচনা লিখতে পারার কথা। আশা করা যায়, তাঁরা কোনো লেখার সারসংক্ষেপ তৈরি করতে পারবেন কিংবা কোনো লেখাকে কাটাছেঁড়া করে সংশোধন করতে পারবেন। কিন্তু এসব দক্ষতা বাংলা পড়ে যে অর্জন করা যায় না, তা বাংলার শিক্ষকেরাও জানেন। যে দু-চারজন যে ভাষাদক্ষ ছেলেমেয়ে দেখা যায়, তাঁরা মূলত নিজের চেষ্টায় তা অর্জন করেছেন। 

দৈনন্দিন জীবনে ও দাপ্তরিক কাজে ভাষাদক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে বাংলা আবশ্যিক কোর্স হিসেবে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এই কোর্সের নকশাও এমনভাবে করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ভাষার প্রকৃত দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানেও সাহিত্য হয়েছে প্রধান পাঠ। আর ব্যাকরণ অংশে যা পড়ানো হয়, তা ব্যবহারিক ভাষা প্রয়োগে কাজে লাগে না। 

সাধারণের মধ্যে এ ধারণা রয়েছে, বাংলা মাতৃভাষা হওয়ার কারণে আমরা বাংলার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল নই। তাই বাংলা পড়া শিখতে দেরি হয়, লিখতে গেলে ভুল হয়। কিন্তু আমাদের ভাষা-দুর্বলতার মূল কারণ শিক্ষাপরিকল্পনার ত্রুটি। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ১২ বছরের সাধারণ বাংলা শেখার মধ্যে লক্ষ্য নির্ধারণে ত্রুটি রয়েছে। প্রথম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই আমরা ধরে নিই, শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখে গেছে। তাই দ্বিতীয় শ্রেণির বই থেকে ভাষা শেখার কোনো কাজ দেওয়া হয় না। অথচ বিভিন্ন জরিপে ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেও বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে না।

বাংলা পড়তে পারা বলতে বোঝানো হয় বুঝে পড়া, কেবল উচ্চারণ করে পড়া নয়। আর লিখতে পারা বলতে বোঝানো হয় নিজের মতো লিখতে পারা। পড়ার ও লেখার ঘাটতি থাকার দরুন অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষার্থীর দুর্বলতা তৈরি হয়। এমনকি বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীর ধীরে ধীরে প্রমিত উচ্চারণেও কথা বলতে পারার কথা। শিক্ষাক্রমে তা নির্দেশ করাও আছে। অথচ এমন কোনো পাঠ বা কার্যক্রম নেই, যাতে শিক্ষার্থী প্রমিত উচ্চারণেও কথা বলতে পারে। তা ছাড়া পড়তে ও লিখতে শেখার মধ্যে ভাষাশিক্ষার প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয় কেবল। এর বাইরেও ভাষাদক্ষতা অর্জনের জন্য আরও অনেক চর্চা ও অনুশীলন রয়েছে। 

বিশেষ করে অনুবাদ ও পরিভাষা তৈরির কাজে ভাষাদক্ষতার প্রয়োজন আছে। বানান ও ভাষারীতির মানোন্নয়নের প্রশ্নেও উচ্চতর ভাষাজ্ঞানের প্রয়োজন। দুঃখজনক ব্যাপার, আমাদের উচ্চতর গবেষণায় ভাষার ব্যাপারে আগ্রহ কমতে শুরু করেছে কয়েক দশক ধরে। এ কারণে ভাষা নিয়ে কাজ করানোর মতো পণ্ডিতজনেরও অভাব তৈরি হয়েছে। ভাষাদক্ষ শিক্ষার্থী তৈরির জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নের সময় লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে। পাঠ্যবই প্রণয়ন, পাঠদানের পদ্ধতি নির্ধারণ ও মূল্যায়নের প্রক্রিয়া ঠিক করার ক্ষেত্রেও সেই লক্ষ্যের কথা মাথায় রাখতে হবে। 

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক