পুলিশকে যেভাবে জনবান্ধব করা যেতে পারে

একটি দৃশ্য কল্পনা করি। শক্ত শিকলে বাঁধা রয়েছে একটি ঘোড়া। মালিক উঠেছে পিঠে। দূরে কোথাও যেতে হবে কাজে। মালিক তাড়া দিচ্ছে। চাবুক মারছে। ঘোড়া জোরে ছুটতে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। মালিক বিরক্ত হচ্ছে। আবার চাবুক মারছে। মালিক খেয়াল করছে না, ঘোড়ার পা বাঁধা রয়েছে শিকলে। ঘোড়া আবার লাফ দিচ্ছে, আবার পড়ে যাচ্ছে। পিঠে চাবুক পড়ছে। এভাবেই চলছে।

আরেকটি গল্প বলি। এক কাঠুরে বনে কুড়াল দিয়ে কাঠ কাটছে। কুড়ালে ধার নেই। সমানে কুপিয়ে যাচ্ছে। কাজ এগোচ্ছে না। কাঠুরে ভাবছে, হাতল পাল্টে দিলেই হবে। নতুন হাতল লাগাল। আবার কোপ। কাজ হচ্ছে না। জোরে কোপ দিতে গিয়ে বারবার হাতল ভাঙছে। নতুন হাতল লাগছে। গাছ কাটা এগোচ্ছে না।

এখানে বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থা হয়েছে গল্পের ঘোড়া ও কুড়ালের মতো। হয়তো তার পা আটকে আছে কোথাও। আমরা সেদিকে খেয়াল করছি না। পা যে আটকে আছে, তার প্রমাণ হলো সে বারবার হোঁচট খাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে। আবার কুড়ালের মতো বারবার ভুল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। ভুল ট্রিটমেন্ট যে দেওয়া হচ্ছে তার প্রমাণ, এর রোগ সারছে না।

ঘোড়ার যেমন পা বাঁধা, পুলিশের পা কোথায় বাঁধা? পুলিশের পা বাঁধা রয়েছে আইনে। যেসব আইন দ্বারা পুলিশ পরিচালিত হয় তা নির্দেশ করছে, বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের নয়, সরকারের বাহিনী। তাই জনবান্ধব পুলিশ চাইলে, প্রথমেই পুলিশের আইনে পরিবর্তন আনতে হবে।

পুলিশপ্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পুরস্কার ও শাস্তির একটি অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ পদ্ধতির বিধান রেখে আইনে পরিবর্তন করা যায়। সেটা করতে না পারলে, বারবার ঘোড়া হোঁচট খাবে। এতে ক্ষতি ঘোড়ারও যেমন, মালিকেরও তেমন।

কুঠারের হাতল পাল্টে কাজ হচ্ছে না। ধার দিতেই হবে। একইভাবে পুলিশে নেতৃত্বে পরিবর্তন করে লাভ নেই। এর সিস্টেম পাল্টাতে হবে। ব্যক্তি নয়, সিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ। সিস্টেম শক্তিশালী হলে, দুর্বল বা দুষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকেও ন্যূনতম ভালো মানের সেবা পাওয়া যায়। সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে হলে জানতে হবে, সিস্টেম বা মেশিনে কী কী রয়েছে। কোথায় কোথায় সমস্যা। যে যন্ত্রাংশে সমস্যা, সেটি পাল্টাতে হবে। অথবা পুরো সিস্টেম বা যন্ত্র নতুন করে প্রতিস্থাপন করতে হবে।

প্রতিটি যন্ত্রের কার্যক্রমের একটি আউটপুট থাকে। পুলিশিং সিস্টেমের আউটপুট বা প্রোডাক্ট হিসেবে জনগণ প্রত্যাশা করে উন্নত পুলিশিং সেবা। এই সেবার মধ্যে রয়েছে অপরাধ প্রতিরোধ, অপরাধ তদন্ত ও অপরাধ দমন। রয়েছে জনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যদি কোনো কারণে আমরা মনে করি, এই দ্রব্যগুলো মানুষ পাচ্ছে না বা দ্রব্যের কোয়ালিটি ভালো নয়, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই সিস্টেমে সমস্যা। সেখানে কাজ করতে হবে।

প্রথমেই বলেছি, আইন পরিবর্তন করার কথা। আইনে পরিবর্তন আনলে, সমস্যার ৮০ শতাংশ নিজে থেকেই সমাধান হবে। বাকি ২০ শতাংশের জন্য মেশিন বা সিস্টেমের ত্রুটি দূর করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে নিয়োগের কথা।

পুলিশে নিয়োগের জন্য জানতে হবে আমি কেমন পুলিশ চাই এবং পুলিশের কাছ থেকে কেমন সেবা চাই। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই পুলিশে সব পর্যায়ে নিয়োগে মূল্যায়ন পদ্ধতি সাজাতে হবে। আমি নিশ্চিত, কাঙ্ক্ষিত সেবা না দিয়ে বা দিতে ব্যর্থ হয়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি একজন সেবাগ্রহীতাকে বলেন যে তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন বা তিনি সাধারণ জ্ঞান বা গণিতে অনেক ভালো, তাতে সেবাগ্রহীতার কিছু আসে–যায় না।

তাই নিয়োগ পরীক্ষায় মূল্যায়ন পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে আমি একজন মানবিক, ন্যায়পরায়ণ, সৎ, সেবার মানসিকতাসম্পন্ন ও মেধাবী কর্মকর্তাকে আলাদা করতে পারি। যেন এমন একজনকে পৃথক করতে পারি, যাঁর মধ্যে একজন আদর্শ পুলিশ হওয়ার সহজাত কিছু গুণ রয়েছে। জাল দিয়ে কাঁকড়া ধরে তার থেকে ইলিশের স্বাদ প্রত্যাশা করা যায় না। আবার নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তারা বাস্তব কর্মক্ষেত্রে কেমন পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন তার খোঁজ রেখে প্রার্থী যাচাইয়ে নিজেদের সাফল্য–ব্যর্থতার খতিয়ান টানতে পারেন পরীক্ষক ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।

এসবের পাশাপাশি, চাকরি ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য ও অনাচার চিহ্নিত করে তা দূর করা প্রয়োজন। বিশেষ করে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত পদমর্যাদার সদস্যদের পদোন্নতির সুযোগ বর্তমানে অত্যন্ত সীমিত। তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তাঁদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন বা বদলাতে অবৈধ আর্থিক লেনদেনকে অসম্ভব করে তোলা দরকার। ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং আদর্শগত ও লিঙ্গগত ভিন্নতার কারণে সব পর্যায়ে হয়রানির সুযোগ বন্ধ করা আবশ্যক।

বদলিকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলা হলেও এর একটি অস্বাভাবিক ক্ষতিকর দিক আছে। সন্তানাদি স্কুল-কলেজপড়ুয়া হলে সব সময় পরিবার সঙ্গে নেওয়া যায় না। সৎ লোক হলে সীমিত আয়ে কর্মস্থলে নিজের খরচ এবং পেছনে নিজ পরিবারের নিয়মিত খরচ। হিমশিম খেতে হয়।

অসৎ কর্মকর্তা হলে তিনি অবৈধ উপার্জনে আরও জড়িয়ে পড়তে পারেন। এতে জনগণ সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে পদায়ন বা বদলাতে এলাকা বা ইউনিট নয়, কাজের ক্ষেত্র বেশি প্রাসঙ্গিক। যিনি যে কাজে বেশি পারদর্শী তাঁকে সেই কাজ দেওয়া।

ভালো একজন কর্মকর্তাকে এক এলাকা বা ইউনিট থেকে সরিয়ে আরেক এলাকা বা ইউনিটে পদায়ন করলে একদিকে ঘাটতি তৈরি হলো, অন্যদিকে প্রাপ্তিযোগ হলো। খারাপ একজন কর্মকর্তাকে এখান থেকে ওখানে সরালেও হিসাব একই। একের কাঁধ থেকে সরিয়ে আরেকের কাঁধে ফেলা। তাই কর্মচারীকে শাস্তি ও পীড়ন দিয়ে নয়, তাঁকে স্বস্তি ও সহযোগিতা দিয়ে তাঁর কাছে অধিকতর সেবা প্রত্যাশা করা যায়। সিস্টেম শক্তিশালী হলে যে কেউ তা মানতে বাধ্য। আবার কমান্ডিং পজিশন ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘন ঘন বদলি প্রশাসন পরিচালনার অদক্ষতাকেই তুলে ধরে। তাই ঘন ঘন বদলির কালচার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

সব ধরনের তদবির ও সুপারিশকে না বলার শক্ত মেকানিজম গড়ে তোলা আবশ্যক। ঊর্ধ্বতনের অফিসে অহেতুক নিয়মিত হাজিরার প্রচলনকে নিরুৎসাহিত করা দরকার। এতে ব্যক্তি তোষণের সংস্কৃতি তীব্রতর হয়। পদোন্নতি ও সাফল্যে সিনিয়র ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে গণ-ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর রীতি বন্ধ হওয়া উচিত।

কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি চর্চার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রচলন হওয়া জরুরি। হাজিরা ও কর্মঘণ্টা নয়, কর্মকর্তা ও সদস্যদের সেবা ও কাজের গুণগত মান এবং কাজের পরিমাণকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ব্যক্তিগত আবেদনের সুযোগের পাশাপাশি কারও অভিযোগ বা আবেদনের জন্য অপেক্ষা না করে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে শনাক্ত করে এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও কর্মকর্তাদের জন্য শাস্তি বা পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক।

অপরাধ দমন নয়, তার প্রতিকারে বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তাহলে অপরাধ ও মামলার সংখ্যা কমবে। আদালতকে লাখো মামলার ভারে জর্জরিত হতে হবে না। বলপ্রয়োগ নয়; নেতৃত্ব, ভালোবাসা, ইনফ্লুয়েসিং ক্যাপাসিটি ও মানবিক গুণাবলি দিয়ে জনসমাবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

পেশাগত বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন থাকা দরকার। যাঁর যে কাজ তাঁকে সেটুকু প্রশিক্ষণই দিতে হবে। সবাইকে সবকিছু শেখানোর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে উচিত। অপরাধ ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে থানায় থানায় কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নিরপেক্ষ, প্রতিনিধিত্বমূলক ও অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তা কার্যকর করা উচিত।

পুলিশ কারও কাছ থেকে কিছু নিলে সংগত কারণেই তার প্রতি একটি দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। এ দায় থেকে বাড়তি সুবিধার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তাই পুলিশের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশের যেকোনো পর্যায়ে সরাসরি দান, অনুদান ও সুবিধা নেওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। সরকারি অর্থ, শক্তি ও সম্পদের অপচয় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষকে বিলাসী করে তোলে। বিলাসিতা মানুষকে আরও লোভী করে। একজন বিলাসিতাকারী কখনোই খেটে খাওয়া মানুষের সেবক হতে পারে না। তাই সরকারি সব কার্যক্রমে অহেতুক অপচয় রোধ করা উচিত।

পুলিশের ইমেজ তলানিতে ঠেকেছে। উপযুক্ত মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স কার্যক্রমের মাধ্যমে ইমেজ উদ্ধারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তথ্য লুকানোর কালচার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। দিন শেষে তা পুলিশের ক্ষতিই ডেকে আনে। তাই মিডিয়াকে তথ্য দিয়ে সহায়তা উচিত। বরং প্রকাশিত তথ্যের মাধ্যমে পুলিশের কোনো সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পেলে তা দূরীকরণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

উল্লেখ্য, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ইউএনডিপির সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়ন ও সংস্কারের জন্য ‘খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ, ২০০৭’ শিরোনামে একটি প্রস্তাবনা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উপস্থাপন করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। সেটি আলোর মুখ দেখেনি। সুধী মহলে সে বিষয়ে পরবর্তী সময়ে খুব জোরালো কোনো অবস্থান দেখা যায়নি।

আমরা সবাই জনবান্ধব পুলিশ চাচ্ছি। কিন্তু শিকল-বন্ধন থেকে পুলিশকে মুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আওয়াজ তুলছি না। পুলিশের দোষ খুঁজতে যতটা তৎপরতা, সমস্যা সমাধানে পুলিশের পাশে দাঁড়ানোর উদাহরণ ততটা চোখে পড়ছে না। এ দ্বিচারিতা পুলিশকে অজনপ্রিয় করে রাখতে সহায়ক হলেও, মূল সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখছে না।

মো. সো‌হেল রানা

অতিরিক্ত ডিআইজি

পু‌লিশ স্টাফ ক‌লেজ বাংলা‌দেশ