নতুন বছর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসার কথা। কিন্তু ২০২৪ সাল দেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের জন্য সম্ভাবনা নিয়ে আসবে নাকি আরও দুর্ভাবনার মধ্যে নিয়ে যাবে, তা আসলে সময়েই বলে দেবে। এ বছর মধ্যবিত্তরা কী কী অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে পড়তে হতে পারে, তা নিয়েই আজকের লেখা।
আইএমএফের কিংবা রেমিট্যান্স নিয়ে আসার চাপে ডলারের রেট বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কত হতে পারে সেই রেট? রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্রুগেলের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে।
ব্রুগেলের ডিসেম্বরের রিপোর্ট অনুসারে এই হার ১৫৪ দশমিক ৫২, বাংলাদেশ ব্যাংকের তা ১০০ শতাংশ। যেহেতু আমরা আমদানিনির্ভর দেশ, ডলারের হার বাড়লে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। কিন্তু এ হার বাড়লে দেশে রেমিট্যান্স আসাও বাড়বে।
মার্চ থেকে তেলের দাম ফ্লোটিং করে দেওয়া হবে, এমনটা বলা হয়েছে। এখনকার হিসাবে ফ্লোটিং করা হলে দাম বাড়ার কথা নয়, কিন্তু পশ্চিম বাংলার সঙ্গে সমন্বয় করতে গেলে দাম বাড়বে। ওয়েবসাইট অনুসারে পশ্চিম বাংলায় ডিজেলের দাম ছিল ৯২.৭৬ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় হয় ১২২ দশমিক ৫২ টাকা (গুগলের কনভারশন হার ধরে)।
বাণিজ্যিক ব্যবহারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর পেট্রোবাংলা লাভে আছে, কিন্তু গতবার বাসাবাড়ির গ্যাসের দাম বাড়েনি। কিন্তু বাসাবাড়ির এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বাড়ছে। ইতিমধ্যে তিতাস গ্যাসের দাম ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে তিতাস। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, এক চুলার ক্ষেত্রে ১ হাজার ৩৮০ ও ২ চুলার ক্ষেত্রে ১ হাজার ৫৯২ টাকা দিতে হবে ব্যবহারকারীদের।
বর্তমানে এক চুলার জন্য ৯৯০ টাকা ও ২ চুলার জন্য ১ হাজার ৮০ টাকা দিতে হয় ব্যবহারকারীদের। (ডেইলি স্টার, ১৬ মে ২০২৩) যদি এলপি গ্যাসের সঙ্গে সমন্বয়ের চিন্তা আসে, দাম বাড়তেও পারে।
বসিয়ে বসিয়ে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য বিদ্যুতে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া লাগে। আইএমএফের চাপে ভর্তুকি তুলে দিলে দাম কেমন হতে পারে, এ-সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব নেই। কিন্তু আমাদের ২০২২-২৩-এ উৎপাদন খরচ ছিল ১১ দশমিক ৮৬ টাকা (শেয়ারবিজ, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩)।
পানিতে ওয়াসার উৎপাদন খরচ আসে ২৫ টাকা/১ হাজার লিটার। এখানেও সরকারের প্রস্তাব আছে, মানুষের আয়ের ওপর ভিত্তি করে হার নির্ধারণ। সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকির প্রস্তাব থাকলেও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য প্রস্তাব ৩১ দশমিক ২৫ টাকা প্রতি ১ হাজার লিটারে। এখন বিভিন্ন ধাপে যে প্রস্তাব আছে, তা সর্বোচ্চ ৫০ টাকা পর্যন্ত আছে। (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৭ জুলাই ২০২২)
এই প্রস্তাবগুলো অনেক আগে থেকেই আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা হয়নি। আসা করি, যদি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, জনমত যাচাই করে যুক্তিযুক্তভাবে করা হবে, যাতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কম হয়।
আইএমএফ কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছে। আর বাংলাদেশ তা থেকে অনেক পিছিয়ে।
বাংলাদেশের অন্যতম করের খাত ছিল আমদানি। আমদানি কমে যাওয়ায় এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ পড়বে বেসরকারি খাতের ওপর।
এনবিআরের উচিত যিনি ট্যাক্স দেন, তাঁর ওপর বোঝা না চাপিয়ে কর আদায়ের আওতা বাড়ানো, তাহলে হয়তো মানুষের ওপর চাপ কম পড়বে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি চাকরির বাজার বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে তা না হয়ে বরং কমছে। সরকারি খাতে কিছু নিয়োগ হলেও বেসরকারি খাত ধুঁকছে।
এ অবস্থা কাটানোর কোনো পথ এখনো দেখা যাচ্ছে না, যা প্রকারান্তরে নিশ্চলতা-স্ফীতিকেই নির্দেশ করে। এই নিশ্চলতা-স্ফীতিকে কাটানোর জন্য প্রথমে ব্যাংক সুদের হার মূল্যস্ফীতির ওপরে রাখতে হবে।
আমি আগের এক লেখায় কীভাবে চাকরির খাত বাড়ানো যায়, তা নিয়ে লিখেছিলাম।
বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে সানেম প্রশ্ন তুলেছিল ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যেখানে বিবিএসের থেকে প্রায় দ্বিগুণ এসেছিল তাদের হিসাবে।
ভিনাগাথাসানের (২০১৩) মতে, কোনো দেশের মূল্যস্ফীতি যদি ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশের বেশি হয়, তা অর্থনীতির উন্নতিকে বিপরীত ধারাতে নিয়ে যায়। আমাদের এই দীর্ঘদিনের মূল্যস্ফীতি এখন দেশকে এই নিশ্চলতা-স্ফীতিতে নিয়ে এসেছে।
খবরের তথ্যানুযায়ী বেশির ভাগ লিস্টেড বেসরকারি কোম্পানির মুনাফা কমছে বা লসে যাচ্ছে। ফলে ছাঁটাই হওয়া বা নিয়োগ কমিয়ে দেওয়া এবং ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব নয়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, আমাদের নতুন অর্থবছরে রেমিট্যান্স আসবে ২৩ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে ছিল তা ২১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।
আমাদের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৭২ বিলিয়ন ডলার (এটা যদিও অনেক উচ্চাভিলাষী, কারণ এই অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন ডলার)। এই ৫৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার এখনো দেশে আসেনি।
শুধু মাত্র গার্মেন্টস দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন অনেক কঠিন। যদিও আমরা ইতিমধ্যে আমদানি ৫ বিলিয়নের নিচে নিয়ে এসেছি। এটা অনেকটা স্বস্তি দেবে। কিন্তু যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারে, অথবা কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়ে যাবে।
এটা আসলে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশের জ্বালানি খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। জ্বালানি আমদানিতে বিপিসি ও পেট্রোবাংলার বকেয়া ৯৭ কোটি ডলার (বণিক বার্তা, ১৭ নভেম্বর ২০২৩)। পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের পাওনা ১৩ হাজার কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩)। পিডিবির কাছে বিভিন্ন সংস্থার পাওনা ২৭ হাজার কোটি টাকা (২৮ জুলাই ২০২৩)।
এখনই বিদ্যুৎ থাকছে না, গত অর্থবছরে গরমের সময় ঢাকার বাইরে বিদ্যুতের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। এবার কী হবে, সময়ই তা বলবে?
আমাদের দেশকে যেকোনো দুর্যোগ থেকে বাঁচিয়ে দেয় কৃষক। কিন্তু ডলারের অভাবে সার আমদানি করা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত সারের ভর্তুকিতে বকেয়া পড়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। (দেশ রূপান্তর, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩) বিদ্যুৎ বা ডিজেলের অভাব হলে সেচ হবে না। তাহলে?
খাদ্য আমদানিতে আমরা বিশ্বে তৃতীয়। আমদানি কমিয়ে দিলে যেসব খাবার বাইরে থেকে আসে, সেগুলোর কী হবে? আমাদের কৃষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে এ দেশে কখনো দুর্ভিক্ষ আসবে না।
মানুষ এখন কম কিনছে। ফলে সিন্ডিকেটও কিছু দাম কমিয়ে দিয়েছে নির্বাচন পর্যন্ত। এর মানে দেখা যায়, ওপর থেকে চাপ এলে দাম কমানো সম্ভব। এখন দেখতে হবে, এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা আছে কি না।
আমদানি করে দাম কমানো কখনো কোনো সমাধান নয়। সরকারের কাছে কি উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে জিনিস পৌঁছানোর হিসাব নেই? তাহলে কেন সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছে না? এখানে কি আমরা অলিগার্কদের কাছে জিম্মি না? এর মধ্যে যদি সরকারি পে স্কেল দেওয়া হয়, জিনিসপত্রের দাম আরও নাগালের বাইরে চলে যাবে।
‘ফুটন্ত ব্যাঙ’ একটা জনপ্রিয় রূপক। একটা ব্যাঙকে যদি আপনি একটি পানিভর্তি পাত্রে রাখেন এবং পাত্রটিকে উত্তপ্ত করতে থাকেন, তবে ব্যাঙটি পানির তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরের তাপমাত্রা ভারসাম্যে রাখতে থাকে। সে পানির উত্তাপ সহ্য করতে থাকে লাফ দিয়ে বেরোনোর পরিবর্তে।
কিন্তু একসময় পানির প্রচণ্ড তাপমাত্রা ব্যাঙের শরীর আর মানিয়ে নিতে পারে না। তখন ব্যাঙটি ফুটন্ত পানির পাত্র থেকে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সে লাফ দিতে পারে না তখন। কারণ, সে তার পুরো শক্তি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করে ফেলেছে।
ব্যাঙের মৃত্যুর কারণটা আসলে গরম পানি নয়। এর কারণ হলো বিপজ্জনক পরিস্থিতির শুরুতে সেই পরিস্থিতি অস্বীকার করে সবকিছু সহ্য করে লাফ না দেওয়াটা। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এই রূপকটি খুবই কার্যকর।
যেহেতু আমরা সব মেনে এ রকম ব্যাঙের মতো গরম পানিতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তাই গরম পানিতে টিকে থাকার জন্য সবার কাছে একটাই অনুরোধ অপচয় কমান, বিনিয়োগের জায়গা খুঁজুন, কাজের পাশাপাশি পার্টটাইম কাজেরও চেষ্টা করুন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে উপযোগী করে গড়ে তুলুন।
অর্থনীতির নেতিবাচক রেখা একসময় আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করবে। সেই সুসময়ের জন্য সবাই অপেক্ষা করুন।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলাম লেখক
ই-মেইল: contact@subail.com