ধর্ম

মক্কা বিজয় ক্ষমা ও উদারতার অনুপম দৃষ্টান্ত

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পর দ্বিতীয় হিজরিতে কুরাইশরা মদিনা আক্রমণ করেন এবং বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হলেও পরের বছর তৃতীয় হিজরি সনের শাওয়াল মাসে (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁরা পুনরায় মদিনা আক্রমণ করেন। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওহুদের যুদ্ধ।

ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে নবীজি (সা.) ওমরাহর উদ্দেশ্যে দেড় হাজার সাহাবিসহ মক্কা গমন করেন। কুরাইশরা বাধা দিলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) হুদাইবিয়া নামক জায়গায় অবস্থান করেন। সেখানেই সম্পাদিত হয় ইতিহাসবিখ্যাত ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’, যা বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সন্ধিচুক্তি।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবাসীদের নিয়ে একটি সভা করলেন। সভার ভাষণে তিনি সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন, ‘হে কুরাইশগণ! অতীতের সব ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো, কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সবাই এক হও। সব মানুষ সমান—এ কথা বিশ্বাস করো।’

হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মক্কার গোত্র হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সঙ্গে এবং ‘বনু বকর’ গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে। এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্বশত্রুতা ছিল। কুরাইশদের প্ররোচনায় ‘বনু বকর’ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে ‘বনু খোজাআ’ গোত্রের আবাসভূমি ‘ওয়াতির’–এর নিভৃত পল্লিতে হামলা করে, অসহায় নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন করে। প্রাণভয়ে কাবায় আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষকেও তারা হত্যা করে।

এ ঘটনার প্রতিকারের জন্য খোজাআ সম্প্রদায় মদিনার মিত্র মুসলমানদের সহযোগিতা চায়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই অপকর্মের প্রতিকারের জন্য দূত মারফত মক্কার কুরাইশ নেতাদের জানালেন, তোমরা বনি খোজাআ গোত্রকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাও, নয়তো বনু বকর গোত্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাতিল করো; না হলে হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে হেতু এ চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। কুরাইশ নেতারা তৃতীয় পন্থাই গ্রহণ করল।

বিশ্বমানবতার কেন্দ্রভূমি মক্কা মুকাররমাকে পঙ্কিলতা মুক্ত করার জন্য অষ্টম হিজরিতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা অভিযানের নীরব আয়োজন করলেন। রমজান মাসে ১০ হাজার সাহাবিসহ মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশে অভিযাত্রা শুরু করেন। মক্কার উপকণ্ঠে এসে ‘মাওয়ারাউজ জাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করলেন। রমজানের ১৯ তারিখ রাতে আবু সুফিয়ান, হাকিম ইবনে নিজাম ও বুদাঈলকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধানে বের হলে হজরত ওমর (রা.)–এর নেতৃত্বে টহলরত ছদ্মবেশী গেরিলা সাহাবিদের হাতে বন্দী হয়ে তাঁরা নবীজি (সা.)–এর কাছে নীত হন।

দীর্ঘ ২১ বছরের নিষ্ঠুরতার নাটের গুরু আবু সুফিয়ানকে রহমতের নবী (সা.) প্রেম–ভালোবাসার দীক্ষা দিলেন, পাষাণ হৃদয় দয়ার সাগরে স্নাত হলো; তিনি ইমান আনলেন। মক্কা জয়ের আগেই প্রিয় নবী (সা.) মক্কাবাসীদের মন জয় করাকে বড় বিজয় অর্জন মনে করলেন। এ সময় নবীজির চাচা হজরত আব্বাস (রা.), যিনি কৌশলগত কারণে মক্কাবাসীদের কাছে তাঁর ইসলাম গ্রহণ গোপন রেখে ছিলেন, তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করলেন।

ভোরে এ উভয় কুরাইশ নেতাকে নবীজি (সা.) শান্তির পয়গাম ঘোষণার জন্য মক্কায় পাঠালেন এবং ঘোষণা দিতে বললেন, ‘যারা কাবা গৃহে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে বা তার নাম বলবে তারা নিরাপদ, যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে তারাও নিরাপদ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

১৯ রমজানে মক্কা বিজয়ের দিন সকালে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন দলকে মক্কার বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘কাউকে আক্রমণ করবে না।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত উসামা ইবনে জায়েদের সঙ্গে উটে চড়ে, অবনত মাথায় সবার শেষে মক্কায় প্রবেশ করলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবাসীদের নিয়ে একটি সভা করলেন। সভার ভাষণে তিনি সাম্য, মৈত্রী ও একতার কথা বললেন, ‘হে কুরাইশগণ! অতীতের সব ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো, কৌলীন্যের গর্ব ভুলে যাও, সবাই এক হও। সব মানুষ সমান—এ কথা বিশ্বাস করো।’

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    smusmangonee@gmail.com