আমার জন্য গ্রীষ্মের অর্থ ছুটি। আর ছুটির অর্থ বাড়ি যাওয়া। বাড়ির পাশের বলেশ্বর নদের তাজা ইলিশ মাছ, জানবিবির (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ট্রান্সপোর্টে অফুরন্ত আড্ডা আর উপভোগ করা সুন্দরবনের মিহিন সাজ।
সদ্য বিগত হওয়া গ্রীষ্মেও এই অর্থের ব্যাঘাত ঘটেনি। গিয়েছিলাম বাড়ি। খেয়েছি তাজা ইলিশ মাছ, ঘুরেছি সুন্দরবনে, সীমাহীন আড্ডা দিয়েছি জানবিবির ট্রান্সপোর্টে। একই সঙ্গে বিগত গ্রীষ্মে সাক্ষাতের সুযোগও হয়েছিল আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন থেকে শুরু করে নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে। কিন্তু চিত্রপটে ক্রমাগত অস্বস্তির দাগ কেটে চলেছে একটি সাক্ষাৎ। এই অস্বস্তি থেকে নিস্তারের আশা নিয়েই আজকের লেখা।
সাক্ষাৎটি ছিল মাওলানা আবদুর রশিদের সঙ্গে, যাঁকে এলাকার সবাই সম্বোধন করে রশিদ হুজুর বলে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় সেই শিশুকাল থেকে। সম্ভবত ১৯৯৯ সালে। তবে ক্রিকেট আমাদের বন্ধুত্বকে পাকাপোক্ত করেছে, যদিও দুজনের মধ্যে বয়সের ফারাক ৪০ বছরেরও বেশি। ক্রিকেটে অত্যন্ত ভক্তি রশিদ হুজুরের। খেলতেনও মারমুখী ক্রিকেট।
ক্রিকেটের পাশাপাশি আলাপেও দুর্দান্ত রশিদ হুজুর। বার্ধক্য রশিদ হুজুরের প্রায় সব শারীরিক শক্তি নিঃশেষিত করলেও জবান এখনো পাকাপোক্ত। তবে এই পাকাপোক্ত জবান সবার জন্য মধুর নয়। কারণ, রশিদ হুজুর আটকে রাখতে পারেন না মনের কথা। আপসে প্রবল অনাগ্রহী বর্তমান সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’–এর মতো সিদ্ধান্তের দোলাচলে ছিলেন না কখনোই রশিদ হুজুর। তাই তাঁকে অপছন্দ করার মানুষের তালিকা বিশাল।
গত জুলাই মাসের এক সকালে রশিদ হুজুরের মাদ্রাসায় কড়া নাড়লাম। স্রোতহীন খালের পাশে প্রায় ৩০ জন ছাত্র নিয়ে রশিদ হুজুরের মাদ্রাসা। এই খালে ছোটবেলায় স্কুল শেষে সাঁতার কাটতাম বিরামহীনভাবে। অসম্ভব স্রোত ছিল তখন। এই খাল নৌকায় পরিপূর্ণ থাকত বিশেষ করে সাপ্তাহিক বাজারের দিন বুধবারে। স্রোত নেই এখন। নিশ্চল খাল আবর্জনায় ভর্তি, নিশ্বাস নেওয়া দায়।
হুজুর আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ানোর প্রায় সব চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থ হলেন চোখের পানি ধরে রাখার প্রচেষ্টায়ও। আলাপ চলল দুপুর পর্যন্ত। জীবন নিয়ে রশিদ হুজুরের আর সংকল্প নেই। নেই চঞ্চলতাও। সম্ভবত কখনোই ছিল না। তবে সীমাহীন উদ্বিগ্নতা আছে বর্তমান বার্ধক্যের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা দুর্ভোগ নিয়ে। এই দুর্ভোগ শুধুই শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং আর্থিক অনটনে বেহাল মাদ্রাসা থেকে শুরু করে মাদ্রাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদদের প্রতিনিয়ত চেকিং পর্যন্ত বিস্তৃত।
মাদ্রাসার প্রবেশমুখের ডান পাশেই রশিদ হুজুরের কক্ষ। গলায় জড়ানো সবুজ গামছা খুলে বিছানা পরিষ্কার করে বসতে দিলেন তিনি। উচ্চ স্বরে মাদ্রাসার সামনের দোকান থেকে দ্রুত লাল–চা নিয়ে আসার তাগাদা দিলেন নাতি মাহমুদকে। হুজুরের পরা স্যান্ডো গেঞ্জি এবং লুঙ্গি ছিল অত্যন্ত পুরোনো। বিছানায় ছড়ানো–ছিটানো ছিল নাতিদের পাঠ্যবই এবং খেলনাগুলো। আর বালিশের পূর্ব পাশে ছিল উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কেনা হুজুরের কালো রঙের রেডিওটি। দেয়ালে ঝুলছিল বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিশাল দুটি মানচিত্র।
আলাপ শুরু করলেন রশিদ হুজুর। পরিবারের হালহকিকত জানতে চাইলেন। জানালেন অপেক্ষায় আছেন দুনিয়া থেকে বিদায়ের। তবে এই অপেক্ষা যে মধুর না সেই কথাও জানান দিলেন অত্যন্ত জোরেশোরে। পুলিশি ঝামেলা, আর্থিক অনটন, বার্ধক্যজনিত নানা অসুবিধার থেকেও যে জীবন থমকে গেছে রাষ্ট্রীয় নানা কলকবজার মধ্যে, নিজ থেকেই সেই কথা খোলাসা করলেন রশিদ হুজুর।
রশিদ হুজুরের মাদ্রাসা এখন স্থানীয় পুলিশের নিয়মিত গন্তব্যস্থল। পুলিশ মাদ্রাসা চেক করতে মাঝেমধ্যেই আসে মধ্যরাতে, যখন বাচ্চারা থাকে ঘুমের জগতে। মধ্যরাতে কোথাও হাজির হওয়া পুলিশের একটি পুরোনো পীড়নকৌশল। মাদ্রাসায় অনাকাঙ্ক্ষিত এই আমন্ত্রণবিহীন মেহমানের নিয়মিত আগমন সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারেন না রশিদ হুজুর। পুলিশ সদস্যদের কাছেও অর্থপূর্ণ ব্যাখ্যা ছিল না তাঁর জন্য।
মার্কিনদের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ আরম্ভের শুরুর পর থেকেই পৃথিবীর প্রায় সবকিছু ‘সিকিউরিটি’ লেন্সের মধ্য দিয়ে বোঝার এক শক্ত প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবণতাকে ওরিয়েন্টালিজমের নতুন ভার্সন বললে অত্যুক্তি হবে না সম্ভবত। এই অভেদ্য প্রবণতা মোটাদাগে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং একাডেমিয়ার চাপিয়ে দেওয়া একধরনের লেন্স, যার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে মার্কিনদের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ নীতি এবং অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর বিনা বাক্যে এই নীতির আত্মস্থকরণের মধ্য দিয়ে।
পুলিশের এ নিয়মিত আগমন শুধুই রশিদ হুজুরের মাদ্রাসায় নয়, বরং আমাদের উপজেলার প্রায় সব মাদ্রাসাতেই এই চেকিং চলে নিয়মিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিক হয়েছে রশিদ হুজুর এবং মাদ্রাসার আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য। জর্জিও আগাম্বেনের ভাষার যা ‘স্টেট অব একসেপশন’ বা অস্বাভাবিকতার স্বাভাবিকীকরণ। এই অস্বাভাবিকতার স্বাভাবিকীকরণে হরণ হয়েছে ছাত্রদের জীবনের সাধারণত্ব; সৃষ্টি করেছে প্রায় অনতিক্রম্য নানা প্রলেপযুক্ত এক ভয়াবহ আতঙ্ক। অভিভাবকদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে অস্বস্তি এবং সন্তানদের ভবিষ্যতের ভয়। তবে এ কথাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে ৯/১১–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে বোমা হামলার নৃশংসতা এখনো তাজা জনস্মৃতিতে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেক মানুষ। রশিদ হুজুরের মাদ্রাসায় নিয়মিত পুলিশি চেকিং যেভাবে ছাত্রদের জীবনের সাধারণত্ব হরণ করেছে, ঠিক একইভাবে জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলোর কারণে জীবনের সাধারণত্ব হারিয়ে গিয়েছিল দেশের লাখ লাখ মানুষের। থেমে গিয়েছিল জনজীবনও।
পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিবিদের বেসুরো টহলও চলতে থাকে নিয়মিত মাদ্রাসায়। এই টহলদারেরা স্থানীয় রাজনীতির হর্তাকর্তা। সর্বদা সব দিকে সজাগ সচল দৃষ্টি রাখেন এই টহলদাররা। এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গীও এই টহলদারেরা। তাই এই টহলদারদের চা-সিগারেটের টাকাপয়সার আবদারে না করার সুযোগ নেই রশিদ হুজুরদের। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় টহলদারদেরও সামলাতে হচ্ছে তাঁদের। এই দুই দিকের চাপ সামলানোর শারীরিক এবং আর্থিক অবস্থার কোনোটাই নেই রশিদ হুজুরদের, তা তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে স্পষ্ট হলো।
মার্কিনদের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ আরম্ভের শুরুর পর থেকেই পৃথিবীর প্রায় সবকিছু ‘সিকিউরিটি’ লেন্সের মধ্য দিয়ে বোঝার এক শক্ত প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রবণতা আপাতদৃষ্টে অত্যন্ত শক্ত ও অভেদ্য। এই প্রবণতাকে ওরিয়েন্টালিজমের নতুন ভার্সন বললে অত্যুক্তি হবে না সম্ভবত। এই অভেদ্য প্রবণতা মোটাদাগে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং একাডেমিয়ার চাপিয়ে দেওয়া একধরনের লেন্স, যার বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে মার্কিনদের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ নীতি এবং অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর বিনা বাক্যে এই নীতির আত্মস্থকরণের মধ্য দিয়ে।
পাঠকদের কাছে ভুল না বোঝার আবদার রাখতে চাই এখানে। কারণ, মার্কিনদের এই নীতিগুলো শুধুই আমাদের দেশে নয় বরং ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আফ্রিকার অনেক দেশই আত্মস্থ করেছে; ‘ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর’ থেকে নিজেদের আলাদা করে গণতন্ত্র, আধুনিকতাবাদ এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদের পক্ষের পক্ষের শক্তি হিসেবে প্রমাণের জন্য।
তবে মার্কিনদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ নীতিগুলো নির্দ্বিধায় বা বিনা প্রশ্নে আত্মস্থ করার মাধ্যমে অ-ইউরোপীয় দেশগুলো আরও বেশি পর্যুদস্ত করে তুলেছে তাদের ভঙ্গুর সামাজিক ব্যবস্থাকে। গোড়া শক্ত করেছে কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের। সমাজকে বিভক্ত করেছে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে।
এই বোঝাপড়ার ভিত্তি জুনিয়র বুশের নীতি থেকে আলাদা নয়—হয় আমাদের সঙ্গে নতুবা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। স্থানিকভাবে যা রূপান্তরিত হয়েছে হয় সেক্যুলার নতুবা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। অনেকটা ঠান্ডা যুদ্ধের উদার এবং বামপন্থী তর্কের কায়দায়।
৯/১১–পরবর্তী জমানায় রশিদ হুজুরদের মতো কায়দা করে বেঁচে থাকা প্রান্তিক মানুষদের যোগাযোগ নেই প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। মূলধারার সমাজ থেকে অনেক দূরে গ্রামে কিংবা মফস্সলে তাঁদের বসবাস। রাজনীতির ছলচাতুরি বুঝতে অক্ষম এই মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল সমাজের সব ধরনের মানুষের। কখনোই তাঁরা জঙ্গিবাদের সমার্থক ছিলেন না, ছিলেন না ধর্মের নামে সন্ত্রাসের। তাঁরা দেশ ও রাজনীতিকে রাজনীতিবিদের কাছে জমা দিয়ে মনোযোগী ছিলেন ধর্মকর্মে। তাঁদের জগৎবোধে ছিল না রাজনীতির মারপ্যাঁচ।
তবে রাষ্ট্র যখন অনেকটা মার্কিন কায়দায় জঙ্গি দমনে শুধুই রাষ্ট্রের আইন ব্যবহার না করে রাজনীতিও ব্যবহার করা শুরু করে, তখন রশিদ হুজুরের মতো প্রান্তিক মানুষজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রচণ্ডভাবে। ঢালাওভাবে অপরাধীকরণ করা হয়েছে তাঁদের। পুলিশি নজরদারি আওতায় এসেছে পুরো পরিবার। যার ফলে হেয় হয়েছেন রাজনৈতিকভাবে। খুইয়েছেন সামাজিক মর্যাদা। সংকুচিত হয়েছে তাঁদের জীবন–জীবিকার। তবে রশিদ হুজুরদের মতো নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষেরা দুর্দান্তভাবে এক শান্ত স্বভাব ধরে রেখেছেন বাহ্যিকভাবে, কিন্তু ভস্মীভূত হয়ে গেছে তাঁদের নিজস্ব দুনিয়া এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে আমি নৃবিজ্ঞানের ক, খ শেখার চেষ্টা করেছি। এতে স্রোতের বিপরীতে চিন্তার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয়। তাই পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং একাডেমিয়ার চাপিয়ে দেওয়া ‘নিরাপত্তার’ লেন্সের মধ্য দিয়ে আমাদের এবং অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর সমাজে ৯/১১–পরবর্তী জমানায় সৃষ্ট বিভাজনকে শুধুই সেক্যুলার কিংবা সাম্প্রদায়িক বর্গের মধ্য দিয়ে পঠনে অনাগ্রহ আছে আমার। বরং এই বিভাজনমূলক বর্গ এবং নীতিগুলোকে আন্তর্জাতিক, অপর নামে পশ্চিমা পুঁজিবাদ বিকাশে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, এই লেন্সকে সামনে রেখে পঠনে আগ্রহী।
৯/১১–পরবর্তী সময়ে মার্কিনদের নেতৃত্বে দুনিয়ার প্রতিটি কোনায় কোনায় খোঁজা শুরু করে সন্ত্রাসী এবং উগ্রবাদীদের। প্রশ্ন উত্থাপন শুরু হয় মানুষের জীবনযাপনের পদ্ধতি ঘিরে। নজরদারি শুরু হয় স্থানীয় মানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা হাজার হাজার বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর। জঙ্গি খোঁজার প্রতিযোগিতা শুরু হয় মসজিদ, মাদ্রাসায় এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে। যদিও মসজিদ-মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে একদল মানুষ ধর্মের নামে অরাজকতা তৈরি করেছে, এমনকি মানুষও খুন করেছে; কিন্তু এ রকম গর্হিত অপরাধের দায় সবার কাঁধে চাপিয়েছে রাষ্ট্র এবং অনেক রাজনৈতিক দল।
সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশকে পাইকারি হারে অপরাধীকরণ এবং উপস্থাপনা করা হয়েছে দেশের শত্রু হিসেবে। রাষ্ট্রের এবং মার্কিনদের এই শত্রুদের দমনে ব্যবহার হয়েছে অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যেহেতু মার্কিনদের চোখে এই শত্রুরা অত্যন্ত ভয়ংকর। তাই অ-ইউরোপীয় দেশগুলো এই ভয়ংকর শত্রুদের খুঁজে বের করতে বাধ্য হয়েছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ডগ স্কোয়াড, রাইফেল, বোমা, বারুদ কিংবা ড্রোন কিনতে এবং তা বিদেশি নানান সংস্থার ঋণের টাকাতেই।
সামাজিক রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারাকে, যার ফলে দেশের ঋণ বেড়েছে রকেটের গতিতে। পশ্চিমের টাকা পশ্চিমেই থেকে গেছে; মধ্যখানে ঋণী হয়েছে দেশ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রান্তিক মানুষ। রশিদ হুজুরের মতো অকেজো হয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের সামাজিক জীবন এবং জীবিকা, যাদের প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে কোনো দেনা-পাওনা নেই।
মধ্যগগনে গ্রীষ্মের সূর্য যখন দহন করে যাচ্ছিল আশপাশের সবকিছু, তখন নাতি মাহমুদ জানালেন গোসলের সময় হয়েছে রশিদ হুজুরের। থেমে গেল দীর্ঘ সুখশ্রাব্য দীর্ঘ আলাপ। নাতির কাঁধে ভর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় এবার বিফল হলেন না তিনি। মাদ্রাসার গেট পর্যন্ত এলেন বিদায় জানাতে।
পকেট থেকে ৫ টাকার দুটি চকচকে নোট বের করে বললেন আমসত্ত্ব কিনে খেতে। আমার পছন্দের লাল–চা আর আমসত্ত্বের কথা ভোলেননি তিনি এই বার্ধক্যেও। সম্ভবত মা-বাবা, শিক্ষক এবং কাছের বন্ধুদের কাছে কখনোই বড় হই না আমরা। আবর্জনাভর্তি খালের ওপর অনেকটা পুলসিরাতসদৃশ কাঠের পুল অতিক্রম করে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম রশিদ হুজুরের চলে যাওয়া। লাঠি আর নাতির কাঁধই এখন রশিদ হুজুরের একমাত্র সম্বল। জানি না আবার কখনো দেখা হবে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে।
রশিদ হুজুরের জীবন এখন তাঁর মাদ্রাসার সামনের মৃত খালের মতো, যেখানে একদা সীমাহীন স্রোত ছিল, ছিল বাহারি প্রাণের, আশার ক্রমাগত বিচ্ছুরণ, ছিল জীবন এবং সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে তুমুল গর্জন—সেই খাল পরিণত হয়েছে আজ আবর্জনাভর্তি নিশ্চল এক প্রাণহীন দেহে। আর এই নিশ্চল দেহ মাঝেমধ্যেই নিশানায় পরিণত হয় স্থানীয় টহলদার, পুলিশ ও রাষ্ট্রের। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় সব অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুর দায়ভার—পেঁয়াজের দাম থেকে ভবন বিধ্বস্ত হওয়া থেকে সবকিছু।
ইংরেজদের প্রায় ২০০ বছরের বিভক্তিমূলক ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল ১৯৪৭–এর মতো বিচ্ছেদ। সাম্প্রদায়িকতা গেঁথে দিয়েছিল উপমহাদেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সম্ভবত আমরা এখনো মার্কিনদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ নীতি বিনা বাক্যে আত্মস্থ করে আমাদের চিন্তার, সমাজ এবং দেশের কী সর্বনাশ করেছি, সেই চিন্তার অবকাশ পাচ্ছি না। তবে এই নীতির আত্মস্থতা আমাদের সমাজকে বহুদিন একত্র হতে যে দেবে না, সেই কথা বলা যায় অনেকটাই স্পষ্টভাবে। আর এই বিভক্তিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে আন্তর্জাতিক ও পশ্চিমা পুঁজি।
রাহুল আনজুম যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা সহকারী