‘পুরোনো ইউরোপ’-এর সামনে নিজেদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের একটাই পথ খোলা আছে। তা হলো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা, যাতে দেশটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়ী হতে পারে। একই সঙ্গে ইউরেশিয়া অঞ্চলে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে একটি মীমাংসার পথ খুঁজে বের করা। সেটা না করতে পারলে, ফ্রান্স ও জার্মানিকে দীর্ঘ মেয়াদে বড় মূল্য চুকাতে হবে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হাতে পশ্চিমা মিত্ররা আধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে থেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করে। ইউক্রেনে আধুনিক অস্ত্র দেওয়ার এই প্রতিশ্রুতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধাক্কা। এ সিদ্ধান্তের বৈশ্বিক প্রভাবও আছে।
সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ইউক্রেনে ব্যয়বহুল যুদ্ধ অভিযানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনবল ও সামরিক সরঞ্জাম খুইয়েছে রাশিয়া। পূর্ব ইউক্রেনে সফল হতে গেলে যে ধরনের আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন, সে সামর্থ্য এখন আর নেই তাদের। ওয়ালেস আরও বলেন, রাশিয়ান বাহিনী বড় কোনো আক্রমণাত্মক অভিযানে অংশ নিয়েছে, এমন কোনো নমুনা দেখতে পাচ্ছে না যুক্তরাজ্য। তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়ান এখন বিশাল ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে দনবাস অঞ্চলে এগোনোর চেষ্টা করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করার পেছনে রাশিয়ার রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ হলো, দিন যত গড়াবে, পশ্চিমা বিশ্ব ততই ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া কমিয়ে দেবে। একসময় পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। আর তখন রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যাহোক, দ্বিধা সত্ত্বেও ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব খুব ভালো করেই তাদের সমর্থন দিয়ে গেছে। যদিও এ যুদ্ধে ইউক্রেন বিজয়ী হতে পারে, সে ধরনের সহযোগিতা তারা করেনি। সম্ভবত পশ্চিমাদের সেই নীতি বদলের সময় এসেছে।
এ যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীর হতাহতের ঘটনা অনেক বেশি। গত এক সপ্তাহের যে খবর, তাতে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ সেনা হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সেনাবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ার আগে পুতিনকে একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া এখন পর্যন্ত একটা দিশাহীন যুদ্ধ পরিচালনা করছে, দেশটির সেনাবাহিনীও দিশাহীনভাবে লড়ে চলেছে। কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানে যুদ্ধ জয় করা নয়—এর আগে আফগানিস্তানে মুজাহিদিদের বিরুদ্ধে রাশিয়া এক দশক ধরে যুদ্ধ করেছিল। কোনো সফলতা না আসায় ব্যাপক হতাশও হতে হয়েছিল। একইভাবে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনী কোনো উদ্যম কিংবা একবিন্দু সংকল্প প্রদর্শন করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো সমর্থন দিয়ে চলেছে। এ নীতি এখন তাদের পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। এক বছর ধরে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেন ও এর পূর্ব ইউরোপীয় বন্ধুদেশগুলো যে অপরিমেয় আত্মত্যাগ এবং বিস্ময়কর রকম ভালো করেছে, সেই অর্জন কী বৃথা যাবে? ইউক্রেন এরই মধ্যে এই যুদ্ধে রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করেছে। আগামী দিনের ইউরোপে শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে কিয়েভ প্রধান একটি রাজনৈতিক শক্তি হতে চলেছে। এমনও হতে পারে, ফ্রান্স-জার্মানিকেন্দ্রিক ইউরোপের যে শক্তিকেন্দ্র, তা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইউক্রেন বড় ভূমিকা পালন করবে।
এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা যত বিলম্বিত হবে, ইউক্রেন পুনর্গঠন এবং মহাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ‘পুরোনো ইউরোপ’কে ততই কড়া মূল্য চুকাতে হবে। বিপরীতক্রমে, ‘পুরোনো ইউরোপ’-এর সহায়তায় ইউক্রেন যত দ্রুত যুদ্ধে জয়ী হবে, তত কম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি হবে তাদের।
ইউরোপকে শিগগিরই যুদ্ধ শেষ করার ও অযথা রক্তপাত বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সামরিক সংঘাতে রাশিয়া জয়ী হয়ে যায় কি না, সেই প্রশ্নই এখন পর্যন্ত পুরোনো ইউরোপের দ্বিধার কারণ। কিন্তু এক বছরের যুদ্ধের ধরন এবং আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করতে গিয়ে গত কয়েক দিনে রাশিয়ান বাহিনীর করুণ পরিণতি থেকে এটা বলা যায় যে যুদ্ধের হাওয়া বদলানো রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়।
ইউক্রেনকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে, সেটি এখন আর প্রকৃত সমস্যা নয়। প্রকৃত সমস্যা হলো, এই সংঘাত থেকে রাশিয়াকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে। রাশিয়া যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ইউরেশিয়া অঞ্চলে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চটজলদি সামরিক অভিযানে যদি রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত হয়, তাহলে মস্কো কিছু বিভ্রমের হাত থেকে মুক্ত হবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করার পেছনে রাশিয়ার রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ হলো, দিন যত গড়াবে, পশ্চিমা বিশ্ব ততই ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া কমিয়ে দেবে। একসময় পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। আর তখন রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যাহোক, দ্বিধা সত্ত্বেও ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব খুব ভালো করেই তাদের সমর্থন দিয়ে গেছে। যদিও এ যুদ্ধে ইউক্রেন বিজয়ী হতে পারে, সে ধরনের সহযোগিতা তারা করেনি। সম্ভবত পশ্চিমাদের সেই নীতি বদলের সময় এসেছে।
এই যুদ্ধে একটা পরিষ্কার ফলাফল এলে চীনও তাদের রাজনৈতিক আচরণ সম্পর্কে আরেকবার ভাবতে বাধ্য হবে। মস্কো যুদ্ধে পরাজিত হলে বেইজিং খুব ভালো করেই এই বার্তা পাবে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কঠোর সংঘাতে জড়ালে তার ফলাফল খুব ভালো না-ও হতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে গোয়েন্দা বেলুন প্রবেশ করায় বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উত্তেজনা বেড়েছে। শুধু বেলুনকাণ্ড নয়, অনেক বিষয়েই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। প্রকৃতপক্ষে এর বিশাল বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ইউক্রেনে শান্তি আসা চীনের জন্য বেশি প্রয়োজন।
ফ্রান্সেসকো সিসচি ইতালিয়ান লেখক ও চীন বিষয়ে বিশারদ
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত