ভারতের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ স্তরে’ কেন দেশে চীনের বিপুল উত্থান

গত বছরের শেষের দিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের টু প্লাস টু মিটিংয়ে ভারত ‘বাংলাদেশ থেকে চীনের ফুটপ্রিন্ট সংকুচিত করার শক্ত প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল মার্কিনদের। এমনটি কূটনৈতিক পাড়ায় বেশ আলোচিত। ভারতীয়দের কেউ কেউ মনে করেছেন, বাংলাদেশ থেকে চীনের ফুটপ্রিন্ট সংকুচিত করার প্রকল্প বেশ ভালোভাবেই কাজ করছে।

তাঁরা তিনটি বিষয় সামনে এনেছেন। এক. ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে কার্যত গা ঢাকা দিতে হয়েছিল।’ নির্বাচনের ঠিক কিছু আগেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চাপে ‘পলিসি শিফট’ করেছে এবং সরকারের সঙ্গে আগের মতোই স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দুই. নতুন মন্ত্রিসভা থেকে চীনপন্থীদের সরানো হয়েছে। তিন. বাংলাদেশ চীন থেকে নতুন করে বড় প্রকল্পে ঋণ বা সহায়তা নিচ্ছে না; বরং চীন থেকে আমদানি কমিয়ে ভারত থেকে আমদানি বাড়াচ্ছে।

শেখ হাসিনার কূটনীতির উল্লেখ করার মতো দিক হচ্ছে, তিনি ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে ‘চীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী’। বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের তহবিল এবং ঠিকাদারি অংশীদারত্ব অপরিহার্য এবং সেটা বাংলাদেশ করছে ভারতের নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করেই।

শেখ হাসিনার দিক থেকে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিনিময়নির্ভর হিসেবে দেখানো হয়। এখানে সম্পর্ক দেখানো হয় উন্নয়ন প্রকল্পভিত্তিক, এখানে পদ্মা সেতু এবং পদ্মা রেলসংযোগের মতো এমন সব প্রকল্পও আছে, যা ভারত ট্রানজিট কিংবা করিডর হিসেবে ব্যবহার করছে বা করবে।

ভারতের আপত্তিতে বাংলাদেশ সোনাদিয়া থেকে সরে এসেছে, তিস্তা অববাহিকা উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করছে না। ঢাকা, সিলেট কিংবা সৈয়দপুর বিমানবন্দরে চীনাদের ঠিকাদারি দেয়নি; মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চলের মতো কৌশলগত অবস্থানে ভারতীয় অর্থনৈতিক জোন স্থানান্তর করেছে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিনদের প্রবেশাধিকারের চাপ সামলে ভারতীয় ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ভারতকে যুক্ত করেছে। চীন থেকে আমদানি কমিয়ে সেটার একটা বড় অংশ ভারতমুখী করেছে।

এসব দিয়ে সরকার ভারতকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে বলে মনে হয়। যেহেতু বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তা সমাধান করে দিয়েছে, তাই শেখ হাসিনা সরকার এখানে ব্যাপক সুবিধা নিতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে ভারত-চীনের মতো দুটি বিবাদমান প্রতিপক্ষকে একসঙ্গে শেখ হাসিনা সরকার নিজের পক্ষে রাখার সাফল্য দেখিয়েছে।

দুই.

এত কিছুর পরও আমরা দেখি, বাংলাদেশ থেকে চীনের ফুটপ্রিন্ট কমানোর বিষয়টি মূলত বাহ্যিক এবং বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে চীনের অবস্থান অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্বের যে ২০টি দেশ বিশাল  অঙ্কের চীনা ঋণ নিয়েছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে। গত এক যুগে চীন বাংলাদেশে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে এবং প্রায় সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এসব ক্ষেত্রে ভারতের যে অংশগ্রহণ, সেই তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।
বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হয়েছে। চীনের কারণে কোয়াড যুক্ত হতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কিছু চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করছে না।

বাংলাদেশের মোট সামরিক আমদানির তিন-চতুর্থাংশ চীন থেকে আসে। কোভিড-১৯-এর পরও পরিমাণের দিক থেকে চীন থেকে আমদানি কমেনি; বরং গত ১০ বছরে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৩ গুণ। চীন থেকে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মাঝারি ও বড় প্রকল্পে চীন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০০৯-১৪ সময়ে এবং তারপরের ১০ বছরে, ঠিক যে সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ স্তরে’ পৌঁছেছে, ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আমদানি, অবকাঠামো উন্নয়ন, কারিগরি, অর্থনীতি এবং সামরিক সব খাতেই ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।

এমনকি বাংলাদেশ চীনের আগ্রহে সাবমেরিন কিনেছে এবং সাবমেরিন ল্যান্ডিং স্টেশনও নির্মাণ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে চীনের ফুটপ্রিন্ট সংকুচিত করে আনার দাবি, এটা আসলে কতটা বাস্তব? নাকি এটা ভারতের ‘স্বপ্ন’ হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। ভারতের বন্ধুত্বের এই উষ্ণতার কালেই কি চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছায়নি?

মূলত করোনা-পরবর্তী সময়ে চীনকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে জল ও স্থলপথে আমদানি বাড়ান। এর বাইরে আমদানির সময়, মজুত রাখার খরচ এবং পরিবহন ব্যয় কমাতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে খাদ্যপণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করেন। এর সঙ্গে সরকারের নীতির সম্পর্ক তেমন নেই।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতু, সবচেয়ে বড় রেল প্রকল্প, সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র—সবই চীনের করা। বিপরীতে রামপালে ভারতের তৈরি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি শুধু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিগত দেড় বছরে অন্তত আটবার বন্ধ হয়েছে। চীন বাংলাদেশের যেসব প্রকল্প করে, সেগুলোর আকার মাঝারি এবং বৃহৎ। ভারতীয় কোম্পানিগুলোর এ ধরনের বড় পরিসরের প্রকল্প সম্পন্ন করার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। ফলে এখানে চীন স্বাভাবিক কারণেই একটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে।

এই যে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ চীন থেকে নতুন ঋণ নিচ্ছে না, বিষয়টি একেবারেই ভুল। বরং প্রকল্পের মান, সময়ক্ষেপণ এবং ঠিকাদার নির্ধারণে বাংলাদেশের গড়িমসির কারণে চীন বেশ কিছু প্রকল্পে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। মূলত চলমান ডলার-সংকটের কারণে বাংলাদেশ নতুন প্রকল্প নিতে পারছে না এবং গড়িমসি করছে।

তা ছাড়া তীব্র ডলার-সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ চীনের নেতৃত্বাধীন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (পূর্বে ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) থেকে প্রায় ৭৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পেতে চলেছে। এর বাইরে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য এনডিবির কাছ থেকে আরও ৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এনডিবি ঋণ চাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।

তিন

যেহেতু ভারতীয় প্রকল্পে তহবিলের অভাব আছে এবং নিরীক্ষাসংক্রান্ত কাজগুলো ভারতীয়রাই করেন, তাই সেসব প্রকল্পে কাজ করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের রাজনীতিক ও আমলা চক্র যথেষ্ট অর্থ সরাতে পারেন না। বিপরীতে চীনা প্রকল্পগুলো বৃহদাকার এবং তহবিল পাওয়া তুলনামূলক সহজ, তাই এসব প্রকল্পে মন্ত্রী-সচিবদের আগ্রহ সব সময়েই বেশি থাকে।

বাংলাদেশের প্রশাসনে যাঁরা ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বিবেচিত, ঠিক তাঁরাই নিজেদের আর্থিক লাভের জন্য চীনা প্রকল্পে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে থাকেন। ভারতীয় প্রকল্পের আকার ছোট হওয়ায় অর্থের পরিমাণ কম এবং ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ বলে সেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ কম; অর্থাৎ ভারতীয় প্রকল্প থেকে ভারতের স্থানীয় বন্ধুরা তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ কামানোর সুযোগ পান না।

দেখা যায়, নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য ভারতের স্থানীয় বন্ধুরা উল্টো চীনের ঋণজাত প্রকল্পের ফাইল দ্রুত প্রসেস, চীনা ঠিকাদারদের সঙ্গে সমঝোতা, বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত হয়ে বিদেশ ভ্রমণ ও বেশুমার খরচ এবং টেবিলের বাইরে গোপন সমঝোতায় জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টা এ রকম যে ভারত যাঁদের নিজের বন্ধু এবং নিজেদের লোক বলে বিবেচনা করে, ঠিক তাঁরাই বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ সুরক্ষা করে যাচ্ছেন।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ও সমঝোতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকাও বিবেচনায় নেওয়ার মতো। দেখা যাচ্ছে, এই গ্রীষ্মে চুক্তি থাকার পরও ফারাক্কা বাঁধের এপারে পদ্মায় সর্বনিম্ন পানি আসছে, যমুনার প্রবাহ সংকীর্ণ হয়েছে আর তিস্তার পানি বন্ধ। বাংলাদেশ ভারতের কাছে আন্তর্জাতিক নদীতে পানির হিস্যা চায় না, তবে ভারতকে চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা অববাহিকা উন্নয়ন প্রকল্পের ভয় দেখায়।

আর্থিক স্বার্থ এবং দুর্নীতির সরাসরি সংযোগ আছে বলে ভারত স্থানীয়ভাবে যতই রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, কিংবা কূটনৈতিকভাবে যতই চাপ দিক না কেন, দিন শেষে বাংলাদেশে চীনের ফুটপ্রিন্ট কমানো ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশে ভারতের সর্বোচ্চ প্রভাবের সময়েই দেশটিতে চীনের বিপুল উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য; উন্নয়নের নীতি ও দর্শন; ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, বেকারত্ব ও বিসিএস। ই-মেইল: faiz.taiyeb@gmail.com