কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের সাংগঠনিকভাবে রাজনীতি-সম্পৃক্ততার নানা মডেল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মডেলটি প্রায় একই রকম।
ব্যতিক্রম শুধু পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়। বাংলাদেশে ৩০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে নির্বাচন হয় না। বড় মিলটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে যখন বাম ফ্রন্ট রাজ্য সরকারে ছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের অঙ্গসংগঠন ‘স্টুডেন্ট ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’র দখলে। এখন পশ্চিমবঙ্গের ৫৫০টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের মধ্যে ৪৭৮টি তৃণমূলের ছাত্র ফ্রন্ট ‘তৃণমূল ছাত্র পরিষদ’ নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশে যাঁরা যখন সরকারে থাকেন, তাঁদের ছাত্রসংগঠন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব বা অরাজকতা সৃষ্টি করে। দেখা গেছে কখনো ছাত্রলীগ, কখনো ছাত্রদল, আবার কখনো ছাত্রশিবিরের আধিপত্য। অন্যরা ক্যাম্পাসছাড়া বা অনুগত প্রজার মতো থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের অন্যত্র অবস্থাটা ভিন্ন।
ভারতে বিভিন্ন ধরন বা টাইপের আটটি ছাত্রসংগঠন রয়েছে। যেমন সর্বভারতীয়, রাজ্যভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক (মুসলিম ও খ্রিষ্টান), কাস্ট বা গোত্রভিত্তিক (দলিত, এসটি, এসসি)। নানা ক্যাটাগরিতে সর্বভারতীয় পর্যায়ে ৩১টি শিক্ষার্থীসংগঠন দেখা যায়, যার মধ্যে ৫ থেকে ৬টির কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ নেই। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে নানা বামপন্থী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সর্বভারতীয় ১০টি ছাত্রসংগঠন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি দলীয় রাজনীতির সমর্থক, কর্মী, নানা দলের সম্মুখ সৈনিক তৈরি করে নিজের মতের প্রসার ও ভিন্নমত দমনের একটি উর্বর ক্ষেত্র হবে, নাকি পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে সুস্থ, সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমান মানুষ ও মানস সৃষ্টি করে সৃষ্টিশীল, আদর্শবান, সচ্চরিত্রবান, নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টির একটি কেন্দ্র বা কারখানা হবে?
এর মধ্যে ৫ থেকে ৭টি মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর। কংগ্রেসের ছাত্রসংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া। বিজেপির সরাসরি ছাত্রসংগঠন দেখা যায় না। ছাত্রদের মধ্যে বিজেপির মিত্র আরএসএসের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। ভারতের সবচেয়ে বড় ছাত্রসংগঠন হচ্ছে সিপিআই (এম)-এর স্টুডেন্ট ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া। ভারতের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত রাজ্যসভা নির্বাচনের আগে ছাত্ররাজনীতির বাড়াবাড়িতে ক্ষুব্ধ হয়ে তা নিয়ন্ত্রণে নতুন নিয়মনীতি চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীও যে আভাস দিয়েছিলেন, তাতে সম্ভাব্য একটি রূপরেখা কল্পনা করা হয়েছিল। যাতে ধারণা করা হয়েছিল, সব ক্যাম্পাসে দলভিত্তিক অঙ্গসংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নানা সংগঠন করতে পারবেন, তবে তা হবে ক্যাম্পাসভিত্তিক। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি মমতার দল।
যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক মত বা দল-সমর্থক ছাত্র গ্রুপ থাকে। কিন্তু তাদের সার্বক্ষণিক কোনো অস্তিত্ব বা অবস্থান টের পাওয়া যায় না। ব্রিটেনে তারা নিজ নিজ শহরের কনজারভেটিভ ক্লাব, লেবার ক্লাব, লিব-ডেম ক্লাব এবং যুক্তরাষ্ট্রে তারা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট ক্লাবে যাতায়াত করে। নির্বাচনের সময় কর্মী হিসেবে এবং দলীয় তহবিল সংগ্রহে কাজ করে।
তবে সব সময় তারা মূল দল থেকে কিছু পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে। দলগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে মূল দলের সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর প্রায় সবাই সামাজিক, শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, বিনোদন ও কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের কিছু চার্টার্ড বা বিধিবদ্ধ দায়িত্ব থাকে।
ছাত্র উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে তারা ছাত্র সংসদে দায়িত্ব পালন করে। ব্রিটেনের বিখ্যাত অক্সফোর্ড ইউনিয়ন মূলত একটি ডিবেটিং সোসাইটি। অনুরূপভাবে ব্রিটেনের বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠন মূলত বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক করার ফোরাম। তবে প্রতিটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নির্বাচিত কোনো ছাত্র সংসদ নেই। নেই প্রকাশ্য জাতীয়ভিত্তিক দলীয় ছাত্রসংগঠনের শাখা কার্যক্রম। তবে বিষয়ভিত্তিক এবং ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত সক্রিয় অনেক ক্লাব দেখা যায়। এ দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রসংগঠনের যে রূপ, ধরন ও প্রকৃতি এবং তাদের নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের যে ধারা ও পদ্ধতি দিন দিন প্রকাশিত ও বিকশিত হচ্ছে, তার নজির পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
দেশের সব বড় রাজনৈতিক দল ও শক্তির অঙ্গসংগঠন হিসেবে জাতীয়ভিত্তিক ছাত্রসংগঠন রয়েছে। সে সংগঠনগুলোর আঞ্চলিক ও স্থানীয় শাখা এবং শিক্ষাঙ্গনভিত্তিক শাখা আছে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলগুলোতেও শাখা সংগঠন ও নির্বাচিত সংসদের বিধান রয়েছে। প্রায় ৩০ বছর ধরে একমাত্র একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে বলে জানা যায়নি। দেশের প্রচলিত আইনে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের বিধান রহিত করা হলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না।
এ দেশে ছাত্ররাজনীতির গর্বিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ছাত্ররাজনীতির নানামুখী প্রকাশ ও বিকাশের এখন নির্মোহ ও সময়োপযোগী মূল্যায়ন প্রয়োজন।
অন্য যেসব সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ অর্জনের সহায়ক, সেগুলোয় অংশগ্রহণ একজন শিক্ষার্থীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এখানে প্রেরণা বা প্রণোদনা থাকতে পারে; কিন্তু জোরজবরদস্তি থাকতে পারে না। সেখানেও এখন দলীয় রাজনীতির প্রভাব লক্ষণীয়। ফলে এসব কার্যক্রমে রাজনীতির কোনো তর্কবিতর্ক নেই।
আর দলীয় সংগঠন মানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল-বেদখল, নির্যাতন, হুমকি, যৌন নিপীড়ন, লাঠিসোঁটা ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। অন্তঃকোন্দলের জেরে প্রতিষ্ঠানে তালা দেওয়া, পরীক্ষা, ক্লাস ও আবাসিক হল বন্ধ করা ইত্যাদি তো আছেই। খুন-জখমের কথাও বলতে হয়। এসবেরই হোতা তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নেতা-কর্মীরাই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি দলীয় রাজনীতির সমর্থক, কর্মী, নানা দলের সম্মুখ সৈনিক তৈরি করে নিজের মতের প্রসার ও ভিন্নমত দমনের একটি উর্বর ক্ষেত্র হবে, নাকি পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে সুস্থ, সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমান মানুষ ও মানস সৃষ্টি করে সৃষ্টিশীল, আদর্শবান, সচ্চরিত্রবান, নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টির একটি কেন্দ্র বা কারখানা হবে?
জাতিকে এ দুটির একটিকে বেছে নিতে হবে। কারণ, দুটি ধারা পাশাপাশি চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে মূলত পাঁচটি অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক. দেশের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিক, দুই. শিক্ষার্থীর অভিভাবক, তিন. শিক্ষকসমাজ, চার. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সর্বশেষ ও পাঁচ. এ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও সরকার। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পুনর্বাসনে এ পাঁচ অংশীজনের যুগপৎ ভূমিকা চাই।
ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ