ভ্লাদিমির পুতিনের অন্তর্ভেদী চোখ দিয়ে ইউরোপের ক্রমবর্ধমান অশান্তিটাকে দেখে নেওয়া যাক। রাশিয়ার এই স্বৈরাচারী শাসক যে দুর্দান্ত একটা বসন্তকাল পার করছেন, সেটা বোঝার জন্য তাঁর হাসিমাখা মুখের ছবি কল্পনা করার প্রয়োজন নেই।
ইউরোপীয় শক্তির কেন্দ্রে থাকা দুটি দেশ—ফ্রান্স ও জার্মানি রাজনৈতিক পচনের একেবারে শেষ স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। গভীর অর্থনৈতিক সংকট এই পচনকে আরও তীব্র করেছে।
ফ্রান্সের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রুশপ্রিয় চরম ডানপন্থীরা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে বড় বিজয় পেয়েছে। আর জার্মানিতে রুশপ্রিয় চরম ডানপন্থীরা বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের দলের চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছে।
ইউরোপীয় নির্বাচন মূলত সরকারগুলোর প্রতি দেশটির জনগণের গণরায়। ফলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের ফলাফল বলছে, শলৎজ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর রাজনৈতিক মৃত্যুর রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। গত রোববারের নির্বাচনে শলৎজ কিংবা মাখোঁ, কারও দলই এমনকি ১৫ শতাংশ ভোট পায়নি।
কেউই তাঁদের রাজনৈতিক লড়াইয়ে মহাদেশটিকে সুসংগঠিত করতে এবং রাশিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারেননি। যদিও তাঁরা দুজনই এটিকেই অস্তিত্বগত বিষয় বলে বর্ণনা করে গেছেন। বলা চলে, ক্রেমলিনের সেই লোকটার হাসি আরও চওড়া হলো।
গত সপ্তাহে মাখোঁ ইউরোপীয় মিত্রদের একত্র করে ইউক্রেনে সামরিক প্রশিক্ষক পাঠানোর একটা জোট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনে পুতিনের সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর প্রথমবারের মতো সেখানে ন্যাটোর প্রত্যক্ষ শক্তি বৃদ্ধি করা।
কিন্তু এ সপ্তাহে মাখোঁ তাঁর নিজের রাজনৈতিক গর্দানটাকে রক্ষার জন্য মধ্যপন্থীদের নিয়ে একটা জোট গড়ার চেষ্টা করে চলেছেন। যদিও এ প্রচেষ্টা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।
মাখোঁ জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার এবং আগামী মাসে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাৎক্ষণিক এ ঘোষণায় তাঁর সরকার, রাজনীতিতে তাঁর পরম্পরা এবং ইউরোপ ও বিশ্বে ফ্রান্সের ভূমিকা—সবকিছুই ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে আবার গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, মাখোঁ পদত্যাগের পরিকল্পনা করেছেন।
এদিকে ফ্রান্সের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে যে জাতীয়তাবাদী চরম ডানপন্থী মারি লো পেনের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিজয়ের প্রকৃত মানে হচ্ছে, এ গ্রীষ্মে ফ্রান্সে তারাই সরকার গঠন করবে; গত রোববারের আগে যেটা এককথায় অকল্পনীয় ছিল। বলা চলে, পুতিনের আনন্দের আর সীমা ধরে রাখা যাচ্ছে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশ দেশের সরকারগুলো এখন চরম ডানপন্থীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন অথবা তাঁরা অংশীদার হয়ে আছেন। তাঁদের সবাই যে ক্রেমলিনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন তা নয়, তবে কেউ কেউ তো বন্ধুভাবাপন্নই। পশ্চিমারা ইউক্রেন পরিত্যাগ করুক কিংবা ইউক্রেন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাক, সেটা দেখে এদের সবাই খুশি না হলেও কেউ কেউ খুশি হবেই।
শলৎজ একজন অযোগ্য রাজনীতিবিদ, সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তিন দলের অকার্যকর জোট নিয়ে গঠন করা একটা সরকার পরিচালনা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। বার্লিনে তাঁর কর্তৃত্ব একেবারেই তলানিতে।
এ সপ্তাহে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এর খবরে বলা হয়েছে, জার্মানির শেয়ারবাজারের প্রধান বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, বার্লিনে ক্ষমতাসীন সরকার ‘বেকুব’। তিনি সতর্ক করে বলেন, কলহে লিপ্ত শলৎজের জোট সরকার জার্মানিকে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
এ সতর্কতা বড় যে ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, সেটা হলো ইউরোপের অর্থনীতি প্রতিযোগিতামূলক থাকতে সক্ষম হচ্ছে না। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে হঠাৎই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং নিজ উদ্যোগে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলো তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সর্বোপরি পুতিন বিশ্বমঞ্চে একজন নায়ক হতে চান। আর তিনি অলস হয়ে বসেও নেই। পুতিনের সাইবার-ট্রোল বিভাগ ইউরোপীয়দের মধ্যে অপতথ্য, গুজব ও প্রতারণার ‘কার্পেট বোমা’ বর্ষণ করে চলেছে। কিন্তু মস্কোর এই আক্রমণ এখানেই থেমে নেই।
পেন্টাগনের ভাষায়, মস্কো এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর সরাসরি আক্রমণ ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মতে, রাশিয়ার সেনা গোয়েন্দা ইউনিট (জিআরইউ) বোমা হামলা ও অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনা করেছে।
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে প্যারিসে। খবরে প্রকাশ, ২৬ বছর বয়সী এক রুশ সেনা প্যারিসের একটি হোটেল কক্ষে আহত হওয়ার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিস্ফোরক সরঞ্জামসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সহিংসতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে তিনি বিস্ফোরক ডিভাইস নিয়ে হোটেলে উঠেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা তাদের হেফাজতে নিয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী ইউরোপের মাটিতে অক্ষশক্তির ওপর প্রথম আক্রমণের ৮০তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্যারিস সফরের ঠিক এক দিন আগে।
রাশিয়ার সেনা গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউর লক্ষ্য দেশের ভেতরে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এবং দেশের বাইরে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ পশ্চিমা দেশগুলোকে ভয় দেখানো ও বিভ্রান্ত করা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশ দেশের সরকারগুলো এখন চরম ডানপন্থীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন অথবা তাঁরা অংশীদার হয়ে আছেন। তাঁদের সবাই যে ক্রেমলিনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন তা নয়, তবে কেউ কেউ তো বন্ধুভাবাপন্নই। পশ্চিমারা ইউক্রেন পরিত্যাগ করুক কিংবা ইউক্রেন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাক, সেটা দেখে এদের সবাই খুশি না হলেও কেউ কেউ খুশি হবেই।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর যে সাময়িক অগ্রযাত্রা, সেটা স্থবির হয়ে গেছে। কিয়েভের জন্য অস্ত্র সহযোগিতা প্যাকেজ দেরিতে হলেও অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি সভা। সে জন্য বড় করে ধন্যবাদ তারা পেতে পারে। কিন্তু এটা পুতিনের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বের বিষয়।
পুতিনের কাছে এখন মূল চিন্তার বিষয় সহিংসতাটাকে টেকসইভাবে টিকিয়ে রাখা, সামরিক খরচের ওপর নির্ভরশীল রাশিয়ার অতি উত্তপ্ত অর্থনীতির ইঞ্জিনকে সচল রাখা এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখা।
আজ হোক কাল হোক, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তখন মস্কোর মাংসপেষণযন্ত্রের সামনে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারাবে কিয়েভ।
পরিস্থিতি বলছে, আপনি পুতিনের অট্টহাসি শুনতে পাচ্ছেন।
লি হকসটেডার ইউরোপীয় বিষয়াদি–বিষয়ক কলামিস্ট
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে