দেশের বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা কবে ‘স্মার্ট’ হবে

স্মার্ট শব্দটি এখন খুবই একটি পরিচিত শব্দ। মেয়ের জামাই খুঁজতে মানুষ স্মার্ট পাত্র খোঁজে। স্মার্ট পাত্র বুঝতে সুন্দর দৈহিক গড়ন, উচ্চপদে চাকরি, ভালো বংশপরিচয় ইত্যাদি বিষয়কে নিশ্চয়ই প্যারামিটার হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এখন আমাদের দেশের আমজনতার হাতে হাতে স্মার্টফোন।

এখন স্মার্টফোন আর কোনো শৌখিন যন্ত্র নয়, বরং এটার মাধ্যমে দ্রুতগতিতে ডেটা ট্রান্সফার, ডেটা সংরক্ষণ, ইন্টারনেট ব্রাউজিং অর্থাৎ একটা আধুনিক কম্পিউটারে যা যা করা সম্ভব, সবই করা যায়। এ ছাড়া প্রায় সব স্মার্টফোনে এখন অত্যাধুনিক ক্যামেরা সংযোজনের ফলে ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে তা যাকে খুশি, যেখানে খুশি পাঠানো অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

স্মার্ট ব্যাংকিং সম্পন্ন হচ্ছে এখন স্মার্টফোনের মাধ্যমে। ঘরে বসেই যাকে খুশি টাকা পাঠানো তাৎক্ষণিকভাবেই সম্ভব হচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিলের জন্য ব্যাংকের দীর্ঘ লাইনে আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন হচ্ছে না, সবই হচ্ছে স্মার্টফোনের মাধ্যমে।

প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ। সবকিছুই করা হচ্ছে মানুষের সেবার জন্য। অবশ্য এ জন্য  গ্রাহককে গুনতে হয় সার্ভিস চার্জ। সুতরাং সব পক্ষেরই  হচ্ছে রমরমা ব্যবসা।

আজকের লেখাটা আমি অন্য একটি স্মার্ট সিস্টেমকে নিয়ে লিখব বলে ঠিক করেছি। তা হলো স্মার্ট পাওয়ার সিস্টেম। প্রথমেই সব পাঠককে বলছি, আমরা বিদ্যুৎবিহীন জীবন কল্পনাই করতে পারি না। আপনাদের বাসার লাইট, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ—সবই বিদ্যুতে চলে। এমনকি মোবাইল ফোনটির চার্জ দিতেও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চয় আপনার একান্ত কাম্য।

প্রথমেই বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার একটি ধারণা দিতে চাই। এটা এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে আমরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ পাই। এটার সঙ্গে যুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ। বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সঞ্চালনব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়।

সঞ্চালনব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় গ্রিড আখ্যায়িত করা যেতে পারে। ওই গ্রিডে বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ উচ্চতর ভোল্টেজ লেভেলে সরবরাহ করা হয়। আবার ওখান থেকেই চাহিদা অনুসারে গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এ জন্য অবশ্য মধ্যবর্তী একটি ধাপ ব্যবহার করা হয়, যা বিতরণব্যবস্থা নামে পরিচিত।

ওই যে দেখবেন আপনাদের অঞ্চলেই কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে অনেক যন্ত্র বসানো রয়েছে। এগুলো হলো ট্রান্সফরমার, যা গ্রিডের উচ্চতর ভোল্টেজকে মধ্যবর্তী লেভেলে নামিয়ে আনে। এখান থেকেই বিতরণব্যবস্থায় এ তারের মাধ্যমে আপনার এলাকায় বা আপনাদের বাসায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়।

আপনাদের অ্যাপার্টমেন্টে বা আপনার এলাকার আরেকটি ট্রান্সফরমার দিয়ে একেবারে ঘরে ব্যবহারের উপযোগী ভোল্টেজ লেভেল দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এই গোটা ব্যবস্থাই হলো গতানুগতিক বা কনভেনশনাল পাওয়ার সিস্টেম।

যেহেতু আমরা এখন স্মার্ট পৃথিবীতে বাস করছি, তাই এখন স্মার্ট বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার ধারণা একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে এখন তো স্মার্ট গ্রিড এক বিশেষ আলোচ্য বিষয়। আপনার সবকিছু স্মার্ট চাই।

অতএব বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা স্মার্ট করতে হবে—এটা আপনারা সবাই অবশ্যই চান। আচ্ছা বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা স্মার্ট হলে কী কী সুবিধা পাওয়া যেতে পারে? গ্রাহকেরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবেন। বিদ্যুতের উৎপাদন, পরিচালন ও সরবরাহব্যবস্থা হবে অধিকতর দক্ষ।

এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম কমে যাবে। স্মার্ট বিদ্যুৎ–ব্যবস্থায় মূল আধুনিকীকরণ হবে গ্রিডে। এখানে ব্যবহার হবে আধুনিক কম্পিউটার, অধিক গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ও অতি সংবেদনশীল সেন্সর।

এ গ্রিডে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ভোক্তারা নিজেরাই উৎপাদন করে নিজের ব্যবহারের অতিরিক্ত অংশ গ্রিডে সরবরাহ করে অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। স্মার্ট গ্রিডে থাকবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ত্রুটি শনাক্তকরণ এবং প্যারালাল সংযোগের মাধ্যমে অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা।

এ ছাড়া গ্রাহক ঘরে বসেই স্মার্ট মিটারিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারবেন দিনের কোন সময়ে তাঁর বিদ্যুৎ বিল কেমন? সুতরাং বিদ্যুৎ বিল কমানোর জন্য শুধু একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমেই তিনি তার কোন যন্ত্র কখন চালাবেন আর বন্ধ রাখবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

কিছুদিন আগের ব্ল্যাকআউটের কথা ভাবুন তো। এটা বেশি সময়ের জন্য অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং সিস্টেম, টেলিযোগাযোগ, ট্রাফিকসহ নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ অচল করে দিত।

স্মার্ট গ্রিডের ধারণা এগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলানোর যোগ্যতা রাখে। কারণ, যে জন্য ব্ল্যাকআউট হতে পারে, স্মার্ট গ্রিড তার সংরক্ষিত ডেটা বিশ্লেষণ করে আগেভাগেই কিছু নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবে। এ জন্য ব্যবহার করা হতে পারে মেশিন লার্নিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটি স্মার্ট গ্রিড আমাদের বিদ্যুৎ–ব্যবস্থায় যোগ করবে স্থিতিশীলতা।

এ ছাড়া যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সৌরঝড় ও সাইবার হামলার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য স্মার্ট গ্রিড দ্রুতগতিতে রুট পরিবর্তন করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ–ব্যবস্থাকে রাখবে সচল। অতি সংক্ষেপে আমি স্মার্ট গ্রিডের প্রয়োজনীয়তা আর কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোকপাত করলাম।

সারা বিশ্বে স্মার্ট গ্রিড নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে এবং এর ব্যাবহারিক প্রয়োগও শুরু করেছে। বাংলাদেশেও এ ব্যাপারে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্মার্ট মিটার স্থাপন করে গ্রাহকসেবা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নেট মিটারিং ধারণা ব্যবহার করে দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে সোলার প্যানেল দিয়ে তৈরি বিদ্যুৎ গ্রাহকরা নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করছেন।

আমাদের দেশে স্মার্ট গ্রিডের পুরো সুফল পেতে হলে সবকিছুর সমন্বয় প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিদ্যুৎ বিভাগ ইতিমধ্যে নেট মিটারিং নির্দেশিকা জাতীয়ভাবে প্রকাশ করেছে। এগুলো খুবই আশার কথা। এর সবকিছুই স্মার্ট গ্রিডের একটি অংশ।

আসল কথা, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার প্রতিটি অংশ সমন্বয় করে একটি সমন্বিত বিদ্যুৎ–ব্যবস্থার জন্য সারা বিশ্ব উঠেপড়ে লেগেছে। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, সারা বিশ্বের পুরোনো বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা স্মার্ট সিস্টেম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। আমরাও নিশ্চয় পিছিয়ে থাকব না। সীমিত সম্পদ, কিন্তু অসাধারণ মেধা নিয়ে অবশ্যই আমরাও এগিয়ে যাব এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াব। স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকেরা কথায় নয়, কাজে হবে স্মার্ট।

ড. মো. আশরাফুল হক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক।