যে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সে দেশেই বারবার গণ–অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়।
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থান হয় ১৯৬৯ সালে। স্বাধীনতার পর প্রথম গণ–অভ্যুত্থান হয় ১৯৯০ সালে। সেই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮–দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭–দলীয় জোট এবং বামপন্থী ৫–দলীয় জোট মিলে ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও শাসনের যে রূপরেখা দিয়েছিল, সেটিই তিন জোটের রূপরেখা হিসেবে পরিচিত। তাদের সঙ্গে অলিখিতভাবে জামায়াতে ইসলামীও ছিল।
১৯৯০ সাল থেকে ২০২৪ সাল—এই ৩৪ বছরে দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের খুব পরিবর্তন না হলেও রাজনীতিকদের ভাগ্যের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আমলাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তাঁরা তাদের লোক হয়ে আখের গুছিয়েছেন।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বামদের যে লড়াকু ভূমিকা ছিল, এবার সেটি সেভাবে দেখা যায়নি। এর পেছনে যেমন ক্ষমতাসীনদের আগ্রাসী মনোভাব কাজ করেছে, তেমনি বামদের মধ্যে সুবিধাবাদিতাও। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বাম দল থেকে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা পরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে লীন হয়ে গেছেন। তাঁরা নিজেদের স্বাতন্ত্র৵ ধরে রাখতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি।
অনেকেই বলে থাকেন, সারা পৃথিবীতে বামদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাঁদের এই বক্তব্য যে কতটা অসার, তা প্রমাণিত হলো শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক নির্বাচনে। সাড়ে সাত দশক ধরে যে দেশ দুই প্রভাবশালী বুর্জোয়া দল ও জোট শাসন করে আসছিল, এবারের নির্বাচনে তাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে পরিবারের ১৫ বছরের স্থায়ী শাসনের অবসানের পর বামপন্থার উত্থান ঘটেছে; কিন্তু বাংলাদেশে ১৫ বছর স্থায়ী শেখ হাসিনা যুগের অবসান হলেও বামপন্থার সম্ভাবনা দেখছি না। নানা নামে ও রঙে ডানপন্থার প্রভাব বাড়ছে।
নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর আমাদের দেশের দুই ভাগ্যবান দল হলো জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি এবং বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ দমন–পীড়নের শিকার হয়েছে; কিন্তু এই দুটি দল বড় দুই দলের যেকোনো একটির সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেকে রক্ষা করেছে। বিএনপির আমলে জামায়াত জোটসঙ্গী হিসেবে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে জাতীয় পার্টিও তাদের জোটসঙ্গী হিসেবে একাধিকবার মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে নিয়েছে। সরকারের সহযোগী হয়েও সংসদে বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করেছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের এই মিত্রতা ছিল কৌশলগত ও সুবিধাবাদী, আদর্শগত নয়। আদর্শগত ঐক্য হলে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির ঐক্য হওয়ার কথা। বিএনপির ১৯ দফা ও জাতীয় পার্টির ১৮ দফার মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। দুটি দলই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধ সংহত করার নীতিতে বিশ্বাসী। জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়ার একটাই কারণ ছিল বিএনপিকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া। এখন আওয়ামী লীগকে ‘শিক্ষা’ দিতে বিএনপি কার কার সঙ্গে ঐক্য করে, সেটাই দেখার বিষয়। সমস্যা হলো ৫ আগস্টের ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানের পর জামায়াত নিজেই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে অন্যান্য ইসলামি দলকে সঙ্গে নিয়ে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতের দুজনের দুটি পথ আলাদা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে যদি আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে দেখাতে পারত, তাহলে দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি ভিন্ন হতো। যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জয়ী হওয়া কী সর্বনাশ ডেকে আনে, আওয়ামী লীগ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
নব্বইয়ে তিন জোট যে রূপরেখা দিয়েছিল, সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির খেয়োখেয়ি রাজনীতিই দায়ী। তিন জোটের রূপরেখায় ছিল হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচার এরশাদ ও তাঁর সরকারের শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এতে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা–বিরোধিতার কথা বলা হয়েছিল। অথচ এক দল স্বৈরাচারের সঙ্গে, আরেক দল সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। শত্রুর শত্রুকে নিজের মিত্র ভেবেছে।
তিন জোটের রূপরেখায় ভোটারদের ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত এবং স্বাধীনভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—উভয়ই নিজের মতো করে প্রতিটি নির্বাচন সাজিয়েছে। ২০০৭ সালে নিজের ছক অনুযায়ী নির্বাচনটি করতে না পেরে বিএনপি কম নিন্দিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪–এ তিনটি সাজানো নির্বাচন করে বেশি নিন্দিত হয়েছে।
২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে যদি আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে দেখাতে পারত, তাহলে দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি ভিন্ন হতো। যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জয়ী হওয়া কী সর্বনাশ ডেকে আনে, আওয়ামী লীগ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
ভবিষ্যতে বিএনপিও এমনটি করলে তাদের পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে আগাম সতর্ক করে দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সমস্যা হলো বিএনপির শীর্ষ নেতারা যত সাধু উপদেশই দিন না কেন, দলের তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা তা শুনছেন না।
গত সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে রক্ষা করার জন্য তিনি নির্বাচনে গেছেন। আওয়ামী লীগ তাঁদের ব্ল্যাকমেল করেছে।
তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। আপনারা অংশ নিলেন কেন?
জবাবে জাপাপ্রধান বলেন, ‘২০১৪ সালের পর থেকে আমাদের দলে অন্যায়ভাবে, বেআইনিভাবে একটি গ্রুপ তৈরি করে আওয়ামী লীগ সব সময় আমাদের ব্ল্যাকমেল (প্রতারণা) করত। সরকারের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ওই গ্রুপ তৎপর হতো। আমাদের দলের প্রতীক ও মালিকানা ওই গ্রুপের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হতো।’
এর অর্থ জি এম কাদের তাঁর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, প্রতীক ও মালিকানা রক্ষা করতে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তিনি ভেবে দেখলেন না, এর মাধ্যমে তাঁরা আওয়ামী লীগের সাজানো নির্বাচনকেই বৈধতা দিলেন। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে তিনি বিরোধী দলের নেতা হলেন, তাঁর দল থেকে একজন উপনেতা হলেন, আরেকজন বিরোধী দলের চিফ হুইপ হলেন। সংসদের অধিবেশনেও যোগ দিলেন।
আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জি এম কাদের স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতার দায় অস্বীকার করছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তিনি ভিন্ন কথা বলেছেন।
২৭ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশন মিলনায়তনে দলের বর্ধিত সভায় জি এম কাদের বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বিএনপির আন্দোলন সফল হবে না। বিদেশি তিনটি বড় শক্তি নির্বাচনকে সফল করতে চেয়েছে। আরও কিছু দেশ সরকারকে (আওয়ামী লীগ) জোরালো সমর্থন দিচ্ছিল।’
ওই অধিবেশনে জাতীয় পার্টির নেতা আরও বলেন, বিএনপি আন্দোলনের নামে ফাঁদে পড়ে যায়। সহিংসতার নামে তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার করে সাজা দেওয়া হয়, নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। দেশের স্বার্থে কাজ করেও বিএনপি সফল হয়নি, আন্দোলনে পরাস্ত হয়েছে।
বিএনপি নিজের দোষ এখন তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে অভিযোগ করে জি এম কাদের বলেন, ‘বিএনপি বলছে, আমি নির্বাচনে না গেলে দেশের ভবিষ্যৎই বদলে যেত। কিন্তু আমি নির্বাচনে যেতাম আর না যেতাম, দেশ এভাবেই চলত, এমন পরিস্থিতিই থাকত।’
এর মাধ্যমে জাপাপ্রধান নিজের নেতৃত্ব রক্ষা করেছেন। দলকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের বিপরীতেই হেটেছেন। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দলের নেতারা যদি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসর হয়, জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি নয় কেন? এই দলের একজন নেতার পোস্টারে এমনও লেখা হয়েছিল, ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও শেখ হাসিনা সমর্থিত।’
কেবল ২০২৪ নয়, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাজানো ও পাতানো নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে জিএম কাদের যে জাতীয় পার্টিকে ফ্যাসিবাদের দোসর নয় বলে দাবি করেছেন, সেটা কতটা যৌক্তিক?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক